এম সাদরুল আহমেদ খান
২১ নভেম্বর বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী দিবসে সকলকে শুভেচ্ছা। আমরা সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের সম্মান জানাই যারা যুদ্ধ ও শান্তির সময়ে দেশের সেবা করেছেন এবং করে চলেছেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের সাহসী আত্মত্যাগের ঋণ আমরা কখনোই শোধ করতে পারব না। যারা মুক্তিযুদ্ধে তাদের জীবন হারিয়েছেন এবং যারা শারীরিক বা মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন সেসব বীর সেনানী এবং তাদের পরিবারের সদস্য এবং প্রিয়জনদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।
৫০ বছর আগে ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম’ ভাষণ থেকে জাতি হিসেবে আমাদের আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে বাঙালি অফিসার ও সৈন্যরা পাকিস্তানের সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনী ত্যাগ করে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন।
দেশমাতৃকার স্বাধীনতার কাজে সশস্ত্র বাহিনীর বাঙালি সদস্যদের সম্পৃক্ততা স্বাধীনতার অনেক আগেই শুরু হয়েছিল, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার মাধ্যমে যা প্রকাশ পায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে সশস্ত্র বাহিনীর কিছু বাঙালি সদস্যদের বিরুদ্ধে ১৯৬৮ সালে পাকিস্তান সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করেছিল, অভিযোগ ছিল তারা ভারতের সাহায্যে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে আলাদা করে একটি নতুন দেশ গঠনের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। বঙ্গবন্ধুসহ সকল আসামীকে গ্রেফতার করা হয় এবং ঢাকা সেনানিবাসে কোর্ট মার্শালে বিচার শুরু হয়। এরই মধ্যে মামলার অন্যতম আসামী বিমান বাহিনীর সার্জেন্ট জহুরুল হককে পাকিস্তানি সেনা হেফাজতে হত্যা করা হয়। এই মামলার বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ প্রবল আন্দোলন শুরু করে। গণআন্দোলনের মুখে পাকিস্তান সরকার মামলা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। মামলা খারিজ হলেও ষড়যন্ত্র ছিল আসল।
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের কালরাতে সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ এবং ইপিআরের বাঙালি সদস্যসরা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রধান লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয় এবং তাদের অনেকেই সেদিন সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সশস্ত্র বাহিনীর বাঙালি সদস্যরা সামরিক চাকরির নিরাপদ জীবন ত্যাগ করে দেশের স্বাধীনতার জন্য মুক্তিবাহিনীতে যোগদান করেন। যুদ্ধক্ষেত্রে সামনের সারিতে লড়াইয়ের পাশাপাশি মুজিব নগর সরকারকে সহায়তা, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ প্রদান, শরণার্থী শিবিরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, চিকিৎসা সহায়তা প্রদান ইত্যাদি কাজে নিয়োজিত ছিলেন তারা। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী এবং বিমান বাহিনীর জন্ম ১৯৭১ সালের যুদ্ধক্ষেত্রে। ১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর আমাদের সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী এবং বিমান বাহিনী পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যৌথ অভিযান শুরু করে। এই যৌথ অভিযানটি ডিসেম্বরের ১ম সপ্তাহে সংঘটিত সম্মিলিত বাহিনীর (মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী) অপারেশনেরও ভিত্তিপ্রস্তর ছিল, যা ১৬ই ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয়ে পরিণত হয়। মুক্তিযুদ্ধে আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর অবদান ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। মুক্তিযুদ্ধে তাদের সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের জন্য বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর সাত সদস্যকে সর্বোচ্চ বীরত্বপূর্ণ বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব দেওয়া হয়। সশস্ত্র বাহিনীর ৫৮ জনকে বীর উত্তম, ১৩৪ জনকে বীর বিক্রম এবং ১৭৮ জনকে বীর প্রতীক খেতাব দেয়া হয়।
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্য একটি সামরিক একাডেমি, সম্মিলিত ট্রেনিং সেন্টার, প্রতিটি সেনা কোরের জন্য আলাদা আলাদা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং অন্যান্য অনেক ইউনিট প্রতিষ্ঠা করেন। জাতির পিতা বিএনএস ইসা খান উদ্বোধন করেন এবং বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জন্য দুটি যুদ্ধজাহাজ ক্রয় করেন। বাংলাদেশ বিমান বাহিনীকে একটি বহুমুখী বাহিনীতে পরিণত করার জন্য তিনি অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান মিগ-২১, আধুনিক পরিবহন বিমান, বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং হেলিকপ্টার ক্রয় করেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর এক স্বৈরশাসক ক্ষমতায় আসেন। সেসময়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নকে উপেক্ষা করা হয়, তাছাড়া তথাকথিত অভ্যুত্থান ও পাল্টা অভ্যুত্থানে সশস্ত্র বাহিনীর বেশকিছু সদস্য নিহত হন। কোর্ট মার্শালের নামে তথাকথিত বিদ্রোহের দায়ে মুক্তিযোদ্ধাসহ সশস্ত্র বাহিনীর অনেক সদস্যকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, অনেককে চাকরি থেকেও বরখাস্ত করা হয়। এর ফলে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী অভিজ্ঞ জনবল ও সরঞ্জামের ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়।
১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদৃষ্টি, অঙ্গীকার ও গতিশীল নেতৃত্বে আমাদের সশস্ত্র বাহিনী যেন নতুন পথের সন্ধান পেয়েছিল। আমাদের সামরিক বাহিনী আধুনিক সরঞ্জাম, অস্ত্র এবং গোলাবারুদ দিয়ে পরিপূর্ণ হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার “ফোর্সেস গোল-২০৩০” সম্পর্কে স্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গী ছিল। তবে দুর্ভাগ্যবশত, আওয়ামী লীগ ২০০১-২০০৮ সাল পর্যন্ত সরকার গঠন করতে পারেনি। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ আবার সরকার গঠন করে এবং এ পর্যন্ত তিন মেয়াদে দায়িত্ব পালন করছে। যার ফলে ‘ফোর্সেস গোল-২০৩০’ ও ‘ভিশন-২০৪১’ নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের সব পরিকল্পনা, ধীরে ধীরে বাস্তবে রূপ নিতে থাকে। নতুন নতুন সেনানিবাস, নৌ ও বিমান ঘাঁটি স্থাপন করা হয়।বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্য শেখ হাসিনার সরকার MBT-2000, VT-5 ট্যাঙ্ক কিনেছে। BTR-80, Otokar cobra, Maxxpro MRAP, BOV M11 আর্মার্ড পার্সোনেল ক্যারিয়ার (APC) কেনা হয়েছে। এছাড়াও WS-22 রকেট, TRG-300 লঞ্চার, NORA B-52, FM-90 সারফেস টু এয়ার মিসাইল (SAM), QW-2 MANPAD, Metis-M অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক মিসাইল, PF-98 অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক রকেট, SLC-2 রাডার MI-17 SH হেলিকপ্টার, ইউরোকপ্টার, বেল 407 হেলিকপ্টার, CASA C295 ট্রান্সপোর্ট এয়ারক্রাফ্ট, ডায়মন্ড DA40 trainer বিমান, Bramor C4EYE মনুষ্যবিহীন এরিয়াল ভেহিকল (UAV) ইত্যাদি ক্রয় করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের আমলে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সংযোজন ০৩৫জি সাবমেরিন, ডর্নিয়ার ২২এনজি বিমান, অগাস্টা এডব্লিউ-১০৯ হেলিকপ্টার এবং এর যুদ্ধ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন ইত্যাদি। এই সময়কালে F-7BGI ফাইটার, YAK-130 জেট ট্রেনার, C-130J পরিবহন, K-8W জেট ট্রেনার, L-410 পরিবহন বিমান, MI-171SH হেলিকপ্টার, Agusta AW139 মেরিটাইম SAR হেলিকপ্টার, AW119KX হেলিকপ্টার ইত্যাদি ক্রয় করা হয়েছে। সরকার এয়ার-ডিফেন্স সিস্টেম FM-90, Selex RAT-31DL AD Rader কিনেছে। বাংলাদেশের ভূখণ্ড এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি নিরাপদ।’ ফোর্সেস গোল-২০৩০’ এবং ‘ভিশন-২০৪১’ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সশস্ত্র বাহিনীর জন্য আরও আধুনিক ও উচ্চ-ক্ষমতাসম্পন্ন সরঞ্জাম, অস্ত্র, গোলাবারুদ, যুদ্ধজাহাজ এবং বিমান ক্রয়ের প্রক্রিয়া চলছে।
বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এভিয়েশন অ্যান্ড অ্যারোস্পেস বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা কার্যক্রম চলছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের কোর্সগুলি আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষার্থী তৈরি করার জন্য প্রণয়ন করা হয়েছে। এখানকার শিক্ষার্থীরা সম্ভাবনাময় সমুদ্র অর্থনীতির জ্ঞান আহরণ করতে এবং অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশে যুদ্ধবিমান, পরিবহন বিমান এবং হেলিকপ্টার তৈরির জ্ঞান অর্জন করতে সক্ষম হবে।
প্রতিষ্ঠার ৫০ বছর পর বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী পেশাদার বাহিনী হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে, এই তিন বাহিনীতে কাজ করা সকল মেধাবী সদস্যদের ধন্যবাদ। তাদের শ্রম, চেতনা, দেশপ্রেম এবং দক্ষতা আমাদের সশস্ত্র বাহিনীকে করে তুলেছে জাতির গর্ব।দেশ এবং বিদেশের বিভিন্ন ক্রান্তিকালে আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা সাহস ও দক্ষতা দেখিয়েছেন। শান্তি রক্ষার জন্য সহানুভূতি ও ত্যাগ দেখিয়েছে। ১৯৮৮ সালের বন্যা, ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় এবং সাম্প্রতিক কোভিড-১৯ মহামারীর মতো সময়ে আমরা তাদেরকে চব্বিশ ঘন্টা দায়িত্ব পালন করতে দেখেছি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনেও আমরা তাদের দেখেছি কৃতিত্বের সাথে দায়িত্ব পালন করতে। বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে দীর্ঘ ১৮ বছর দায়িত্ব পালন করতে পেরে আমি গর্বিত এবং সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী এবং বিমান বাহিনীর কর্মীরা– যারা শান্তিতে সমরে সর্বদা অবদান রেখে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে মুক্ত রাখে, তাদের এবং তাদের পরিবারের সকলের জন্যও আমি গর্বিত। আজ ২১ নভেম্বর আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর সোনালী দিন। আমাদের স্বাধীনতা, শান্তি এবং গণতন্ত্র রক্ষায় তাদের নিঃস্বার্থ, উৎসর্গ এবং সাহসিকতার জন্য আমরা তাদের ধন্যবাদ জানাই। তাদের সকলের প্রতি শ্রদ্ধা, ধন্যবাদ এবং আন্তরিক কৃতজ্ঞতা।