মুহুরী চরে বছরে ১ হাজার ১’শ ২৭ কোটি টাকার মাছ উৎপাদন

top Banner

মোহাম্মদ ইউসুফ

মিরসরাই উপজেলায় গড়ে উঠেছে দেশের সর্ব বৃহৎ মৎস্য জোন। প্রায় ৭ হাজার একর জমিতে গড়ে উঠা এসব মৎস্য প্রকল্প থেকে বছরে প্রায় ৪৯ হাজার মেট্রিকটন মাছ উৎপাদন হয়। প্রতি সিজনে এসব মৎস্য প্রকল্প থেকে ১ হাজার ১’শ ২৭ কোটি টাকার মাছ বিক্রি করছেন চাষীরা। মুহুরী চর মৎস্য প্রকল্প থেকে প্রতিদিন ৭০-৮০ মেট্রিক টনের বেশি মাছ দেশের বিভিন্ন বাজারে আমিষের যোগান দিচ্ছে।

১৯৮৪ সালে সরকার ফেনী নদীর মিরসরাই-সোনাগাজী অংশে প্রায় ৫ কিলোমিটার পর্যন্ত বাঁধ নির্মাণের পর প্রায় ৫০ হাজার একরের অধিক চর জেগে উঠে। এই বাঁধ দিয়ে পশ্চিম দিকে যেতে বাঁধের দক্ষিনে চোখ যতদূর যায় ততদূও পর্যন্ত শতশত হেক্টর জমিতে শুধু মৎস্য প্রকল্প। চট্টগ্রাম নোয়াখালী, ফেনী জেলার ৭০ ভাগ মৎস্য চাহিদা পুরণ কওে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যাচ্ছে মূহুরী প্রকল্পের মাছ। এখানে পাঙ্গাস, কার্প, তেলাফিয়া, গুলশা, পাবদা, শিং, কৈ ইত্যাদি জাতীয় মাছের চাষ হচ্ছে। বিগত ২৫ বছরে মিঠা পানির মাছ চাষের জন্য বিখ্যাত মুহুরী প্রকল্প সারা দেশের সবচে বড় মৎস্য জোন হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। দেশের চাহিদা পূরণ করে বিদেশে রপ্তানী হচ্ছে এখানের মাছ।

১৯৯৬ সালের দিকে সাবেক চেয়ারম্যান মাঈনুল ইসলাম, আবুল খায়ের কোম্পানী, বাবুল চৌধুরী, এম.এইচ. লাভলু চৌধুরী এরা আধুনিক পদ্ধতিতে মৎস্য চাষ শুরু করেন। তাদের সফলতার পথ ধরে ধীরে ধীরে এলাকার শিক্ষিত বেকার যুবকরা চাকুরীর পিছে না ছুটে গড়ে তোলেন শতশত মৎস্য প্রকল্প। বর্তমানে মৎস্য চাষে বিপ্লব ঘটিয়ে দেশের সবচে বড় মৎস্য জোন হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে মুহুরী চরের মৎস্য প্রকল্প এলাকা। এখানে বাণিজ্যিকভাবে আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তায় মৎস্য প্রকল্প গড়ে তুলেছে বসুন্ধরা গ্রুপ, মেরিডিয়ান গ্রুপ, ক্লিফটন গ্রæপ, আবুল খায়ের কোম্পানী, মামুন গ্রæপ, সততা ফিস প্রজেক্ট, রিংকু ফিস প্রজেক্টসহ ৫ শতাধীক মৎস্য প্রকল্প। প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে প্রায় ১০ হাজার শ্রমজীবি মানুষ মৎস্য প্রকল্পের সাথে জড়িত রয়েছে। এদের এখন একমাত্র জীবিকার অবলম্বন মৎস্য চাষ।

উপজেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা যায়, বছরে একর প্রতি সর্বনিন্ম ৭ মেট্রিকটন মাছ উৎপাদন হলে প্রায় ৭ হাজার একর জমিতে ৪৯ হাজার মেট্রিকটন মাছ উৎপাদন হয়। প্রতি কেজি মাছ গড়ে ২৩০ টাকা দরে বিক্রি হলেও যার বাজার মূল্য দাঁড়ায় প্রায় ১ হাজার ১’শ ২৭ কোটি টাকা। প্রতি কেজি মাছ উৎপাদনের জন্য ভাসমান খাদ্য প্রয়োজন হয় ১ কেজি ৩’শ গ্রাম আর ডুবন্ত খাদ্য প্রয়োজন হয় ১ কেজি ২’শ গ্রাম। সে হিসেবে প্রতি বছর ৬৩ হাজার ৭’শ মেট্রিকটন খাদ্য প্রয়োজন হয়। প্রতিটন খাদ্য গড়ে ৫০ হাজার টাকা দরে প্রায় ৩’শ ১৮ কোটি ৫০ লক্ষ টাকার খাদ্য প্রয়োজন হয়।

মুহুরী চর থেকে প্রতি বছর সরকার কোটি কোটি টাকার রাজস্ব আয় করলেও এখানকার মৎস্য চাষীরা সরকারী সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। স্থানীয় মৎস্য চাষীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, মাছ পরিবহন ও খাদ্য সরবরাহের জন্য অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রধান অন্তরায়। এছাড়া প্রকল্পে পানি সেচ ও নিষ্কাশনের জন্য কোন ড্রেনেজ ব্যবস্থা নেই। শুষ্ক মৌসুমে মৎস্য প্রকল্পগুলোতে মিঠা পানি সরবরাহের ব্যবস্থা নেই। মুহুরী সেচ প্রকল্পের উজান থেকে পাইপ লাইনের মাধ্যমে মৎস্য প্রকল্পে মিঠা পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করা হলে মৎস্য উৎপাদন তুলনামূলক কয়েকগুন বেড়ে যাবে বলে মনে করেন চাষীরা। রাস্তার পাশের প্রকল্পগুলোতে বিদ্যুৎ সরবরাহ থাকলেও চরের ভেতরে অবস্থিত প্রকল্পগুলোতে বিদ্যুতের কোন ব্যবস্থা নেই। বিদ্যুৎ ব্যবস্থা না থাকায় প্রকল্পে খাদ্য দেওয়া, ডিপ টিউবওয়েল দিয়ে পানি তোলা সহ আধুনিক প্রযুক্তিতে মৎস্য উৎপাদন করা যাচ্ছে না।

শেখ ফরিদ মৎস্য প্রকল্পের সত্ত¡াধিকারী মোঃ শেখ ফরিদ জানান, মুহুরী প্রজেক্ট তার ১৫০ একরের মৎস্য প্রকল্প রয়েছে। বিভিন্ন প্রকল্প থেকে প্রতিদিন ৭০-৮০টন মাছ চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন বাজারে বিক্রির জন্য নেওয়া হয়। এখানে মৎস্য ও খাদ্য পরিবহনের জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থা অত্যন্ত নাজুক। এছাড়া মাছের রোগ বালাই হলে কোন প্রতিষ্ঠান থেকে পরামর্শ পাওয়া যায়না। মিরসরাই থানা থেকে মুহুরী প্রজেক্টের দূরত্ব প্রায় ১৮ কিলোমিটার এজন্য এখানে একটি পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপন করা আমাদের দীর্ঘদিনের দাবী।
আনোয়ার এগ্রো লিমিটেডের সত্ত্বাধিকারী আনোয়ার হোসেন বলেন, মুহুরী প্রজেক্ট এলাকায় তার ১৩০ একরের মৎস্য প্রকল্প আছে। মাছ চাষীদের টাকা লেনদেনের জন্য ব্যাংক শাখা জরুরী প্রয়োজন। মিরসরাই উপজেলা ও সোনাগাজি উপজেলার বৃহৎ অংশ নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর গড়ে উঠছে। যেখানে অনেক মৎস্য প্রকল্প অধিগ্রহনের সম্ভাবনা রয়েছে। সরকারের উচিৎ মৎস্য প্রকল্পের ক্ষতি না করে মাষ্টার প্লান করে পরিকল্পিত ভাবে মৎস্যজোন স্থাপন করা।

রপ্তানীকারক প্রতিষ্ঠান কিছমত ট্রেডিং এর সত্ত্বাধিকারী কমরুদ্দীন চৌধুরী বলেন, তিনি মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে মাছ সহ বিভিন্ন কাঁচামাল রপ্তানী করে থাকেন। মুহুরী প্রজেক্ট এলাকায় শুধুমাত্র বরফকল না থাকার কারণে বছরে কোটি কোটি টাকার লোকসান গুনতে হচ্ছে স্থানীয় মৎস্য চাষীদের। এখানকার মাছ বাজারজাত করার সময় বরফকল না থাকায় অনেক সময় মাছ পঁচে যায়। ফলে ব্যবসায়ীদের অনেক টাকা লোকসান গুনতে হয়। বরফকল স্থাপন করা হলে এখানকার মাছ দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানী করা যাবে।

মিরসরাই উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা নাসিম আল মাহমুদ বলেন, মিরসরাইয়ে মৎস্য প্রকল্পের উজ্জ্বল সম্ভাবনা এখন সারাদেশের জন্য দৃষ্টান্ত। এখানকার মৎস্য চাষীরা তাদের নিজেদের উদ্ভাবিত প্রযুক্তিতে মাছ চাষ করে থাকেন। যেখানে স্বাভাবিকের চেয়ে কয়েকগুন বেশী মাছ উৎপাদন হয়। আধুনিক প্রযুক্তিতে মাছ চাষ করার জন্য সরকার নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।

আরো খবর