এম মাঈন উদ্দিন: মিরসরাইয়ে উজাড় হচ্ছে উপকূলীয় বনাঞ্চল। মানবসৃষ্ট বিপর্যয়গুলোর কারণে বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। ধ্বংস হচ্ছে জীব বৈচিত্র। হুমকির মুখে পড়েছে এখানকার পরিবেশ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ুর ক্ষতিকর প্রভাবে দেশের প্রাকৃতিক বনায়ন ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। মরুভূমির রূপ নিচ্ছে উপকূলীয় এলাকা। জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব ও মিরসরাইয়ে গড়ে উঠা অর্থনৈতিক অঞ্চলের কারণে মিরসরাইয়ের প্রায় ৭০ শতাংশ উপকূলীয় বনাঞ্চল ধ্বংস হয়েছে।
মিরসরাই উপকূলীয় বনবিট অফিস সূত্র জানায়, উপজেলায় মোট উপকূলীয় এলাকা ২৫ কিলোমিটার হলেও গত কয়েক বছর মুহুরী নদী ও বঙ্গোপসাগরের মোহনায় নতুন চর জেগে ওঠায় বর্তমানে এর পরিমাণ কয়েকগুণ বেড়েছে।
জানা গেছে, শিল্পাঞ্চলের জন্য উপকূলীয় এলাকার ২৬ হাজার একর সংরক্ষিত বন উজাড় হওয়ায় খাদ্য ও পানির সংকটে হুমকির মুখে জীববৈচিত্র। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগরের মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলের কাজের জন্য উপকূলীয় ২৬ হাজার একর ম্যানগ্রোভ বন অধিগ্রহণ করে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)। এর দুই-তৃতীয়াংশ বন ইতিমধ্যে কেটে ফেলা হয়েছে। এছাড়া প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা প্রতিহত করতে মোট বনভূমির পরিমাণ বাড়ানোর লক্ষে প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে নতুন চারা লাগানো হলেও জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবে তা সম্ভব হচ্ছে না। প্রাকৃতিকভাবে ও মানুষের কারণে বনভূমি কমে যাওয়ায় বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির মূল্যবান গাছ। ফলজ, ওষুধিসহ মহামূল্যবান কাঠের যোগান নেমে এসেছে শুন্যের কোটায়। লবণাক্ততা সহিষ্ণু বিভিন্ন প্রজাতির গাছ কমে এসেছে।
জানা গেছে, প্রকাশ্যে দিনদুপুরে উপকূলীয় বনাঞ্চলের গাছ কেটে সাবাড় করছে দূর্বৃত্তরা। উপজেলার উপকূলীয় বনাঞ্চলে চলছে গাছ কাটার মহোৎসব। গাছ খেকোদের এমন কর্মকান্ড ঘিরে বন বিভাগ কর্মকতাদের দায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন ওঠেছে। যদিও এমন পরিস্থিতে জনবল সংকটের অজুহাত মিরসরাই উপকূলীয় বন রেঞ্জ কর্মকর্তা আব্দুল গফুর মোল্লার। তার দাবি এক্ষেত্রে তাদের ভূমিকার চাইতেও বেজার ভূমিকা বেশি।
গোপন সূত্রে জানা গেছে, গাছ খেকোরা দিনের বেলায় বড় বড় গাছের ডালপালা কেটে নেয় এবং রাতের আঁধারে সেই গাছ গুলোর মূল অংশ কেটে গুড়ি রেখে যায়। রাতের আঁধারে সড়কে গাছের গাড়ির শব্দে স্থানীয়দের জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে।
এদিকে, প্রাকৃতিক বনভূমি ধ্বংসের ফলে এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে এ অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রায়। একসময় এ অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রা চলতো অনেকাংশে বনভূমি থেকে বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদ সম্পদ আহরণ করে। কিন্তু, বর্তমানে সে পথ সম্পূর্ণ বন্ধ হওয়ার পথে।
চট্টগ্রাম পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক মুফিদুল আলম বলেন, ‘মিরসরাইসহ এর আশপাশের এলাকায় দ্রুততার সঙ্গে যে হারে প্রাকৃতিক বনায়ন কমে আসছে, তা সত্যিই উদ্বেগজনক। বিপন্ন বনায়নের তুলনায় কৃত্রিম বনভূমি গড়ে তোলাও সম্ভব হচ্ছে না। ফলে, ভবিষ্যতে এ অঞ্চলে চরম বিপর্যয় নেমে আসার আশঙ্কা রয়েছে।’
অপরদিকে, জলবায়ু পরিবর্তনে চরম হুমকির মুখে পড়েছে এই অঞ্চলের জীববৈচিত্র উদ্বেগজনক হারে বনভূমি কমে যাওয়ায় পাখিদের অভয়ারণ্য কমে এসেছে। একই সঙ্গে কমে গেছে বন্যপ্রাণীদের চারণ ও বাসভূমি।
বনবিভাগ, পশুসম্পদ অফিস ও স্থানীয় সূত্র জানায়, অতীতে উপজেলার পাহাড়ি ও উপকূলীয় বনে বিভিন্ন প্রজাতির বন মোরগ, হরিণ, বাঘ, হনুমান, শুকর, মহিষ, ছাগল, সাপ, গুঁইসাপ, কচ্ছপ, বনবিড়াল, বন্য হাতিসহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণী ও জীবজন্তুর দেখা মিলতো। কিন্তু বর্তমানে সচরাচর এসব প্রাণী আর দেখা যায় না।
এ বিষয়ে মিরসরাই উপকূলীয় বন রেঞ্জ কর্মকর্তা আব্দুল গফুর মোল্লা জানান, আমাদের ভূমিকার চাইতে বড় ভূমিকা হচ্ছে বেজা কর্তৃপক্ষের। কিন্তু তাদের দায়িত্বশীল ভূমিকা নেই। আমরা চেষ্টা করতেছি কিন্তু বেজা কোন পদক্ষেপ নিচ্ছেন না। বেজার নিকট অনেক বার শরণাপন্ন হয়েছি। কিন্তু তাদের কোন সহযোগিতা পাচ্ছি না। আমাদের জনবল কম, ওনাদের আওতায় তো পুলিশ, আনসার আছে আমি বলেছি যৌথ ভাবে যদি টহল বা কিছু করা যায় তাহলে বন্ধ করা সম্ভব। তিনি আরো জানান, উপকূলীয় প্রায় ২৬ হাজার একর ম্যানগ্রোভ বন বেজা অধিগ্রহণ করে ফেলেছে। এর দুই-তৃতীয়াংশ ইতিমধ্যে কেটে ফেলা হয়েছে।
সারেজমিনে দেখা গেছে, বঙ্গোপসাগরের তীর ঘেঁষে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষার্থে গড়ে উঠা উপকূলীয় বন দূর্বৃত্তদের কুঠারের আঘাতে এ যেন খেলার মাঠে পরিণত হচ্ছে। বনের বেশ কয়েক জায়গা দিয়ে অবৈধ কাঠের গাড়ির চাকায় পিষ্ট হয়ে সৃষ্টি হয়েছে বিশাল বিশাল সড়ক। ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখা মিলে বড় বড় গাছের গুড়ি। আবার বনের গহীন ভেতর থেকে দুপুর বেলায় গাছ কাটার ঠুক-ঠাক শব্দ শোনা যায় প্রতিনিয়ত।