উপজেলার ইছাখালী ইউনিয়নের ভূঁইয়া গ্রামের বাসিন্দা সৈয়দুল হক (৪৫)। যিনি ছোটবেলা থেকে ভেড়া পালন করছেন। দাদার আমল থেকে শুরু করে এখনো ভেড়া পালনই তার আয়ের একমাত্র উৎস। শুধু সৈয়দুল হক নয়, এভাবে ভেড়া পালন করে জীবিকা নির্বাহ করেন আবু জাফর, ফারুক বলি, সাব্বির সহ অনেকে। তবে চারণভূমি কমে যাওয়া ও খাদ্য সংকটের কারণে ক্রমান্বয়ে কমে যাচ্ছে ভেড়ার সংখ্যা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মিরসরাই উপজেলার উপকূলীয় ইউনিয়ন ইছাখালী, মঘাদিয়া, সাহেরখালী ইউনিয়নের চরে এক সময় ঝাঁকে ঝাঁকে ভেড়ার দল চোখে পড়তো। এখানকার প্রায় অর্ধশত লোকের কাছে প্রায় ৫ হাজারের বেশি ভেড়া ছিল। জেগে উঠা চরে অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে উঠায় চারণভূমি কমে যাওয়ায় ও খাদ্য সংকটের কারণে ভেড়ার সংখ্যা দিন দিন কমছে। বিগত ১০ বছরে খামারি কমেছে প্রায় ৭০ শতাংশ। তবে এখনো কিছু খামারি পেশা ধরে রেখেছে। কারণ তাদের বংশগত পেশা ভেড়া লালন-পালন করা।
সরেজমিনে ইছাখালী ইউনিয়নের বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, একসাথে দল বেঁধে শতাধিক ভেড়া মেরিন ড্রাইভে গজিয়ে উঠা ঘাষ খাচ্ছে। পেছনে একজন রাখাল ভেড়াগুলো তদারকি করছে। দেখেন মনে হবে এ যেন ভেড়ার রাজ্য! সন্ধ্যার কিছুক্ষণ আগে লাইন ধরে মেরিন ড্রাইভের উত্তর পাশে অবস্থিত খামারে চলে ভেড়াগুলো।
উপজেলার ইছাখালী ইউনিয়নের ভূঁইয়া গ্রামের হাফিজুর রহমানের ছেলে সৈয়দুল হক বলেন, দাদার আমল থেকে ভেড়া পালন করে আসছি। সব ভেড়া সারাদিন চরাঞ্চলে ঘুরে সন্ধ্যার আগে খামারে ফিরে আসে। আমার বাবাও ভেড়া পালন করেছেন। তখন একরের পর একর খালি জায়গা ছিল, অবাধে বিচরণ করতে পারত পশুগুলো। বাবার পর প্রায় ৩০ বছর ধরে আমি ভেড়া পালন করে আসছি। ভেড়া বিক্রির টাকায় নতুন ঘর করেছি, মেয়ে বিয়ে দিয়েছি। ৪-৫ বছর আগে আমার খামারে ৩৫০টি ভেড়া ছিল। এখন কমে গেছে, রয়েছে ২৪০টি ভেড়া। তবে আগামীতে হয়তো আরো কমে যাবে। তিনি আরো বলেন, আমার খামারে ৮ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ২১ হাজার টাকা দামের ভেড়া রয়েছে। গত কোরবানে ৬০টি ভেড়া বিক্রি করেছি। বাজারে নেয়া প্রয়োজন হয়নি খামারে এসে ভেড়া কিনে নিয়ে যায় লোকজন। ভেড়া পালনের জন্য মাসে ৮০০০ টাকা বেতনে দুজন লোক নিয়োজিত থাকে। প্রায় সময় খামার থেকে ভেড়া বিক্রি করা হয়। সৈয়দুল হক আরো বলেন, আমার পরিবারের আয়ের একমাত্র উৎস ভেড়া পালন। ভেড়া ছাড়া আমার কাছে ৮টি মহিষ রয়েছে।
উপজেলার টেকেরহাট এলাকার বাসিন্দা খামারি আবু জাফর বলেন, ভেড়া পালন আমাদের পেশা। চরে খামারে এখনো শতাধিক ভেড়া রয়েছে। এক সময় আমাদের পরিবারে প্রায় ৫০০ ভেড়া ছিল। এখন আলাদা হয়ে যাওয়ার কারণে অর্ধেক আমার ভাই ফারুক বলি পালন করছে। পশু লালন-পালন করে আমরা জীবিকা নির্বাহ করে থাকি। ভেড়া ছাড়াও আমার খামারে ৯টি মহিষ ও ১৬টি গরু রয়েছে।
আরেক খামারি ফারুক বলি বলেন, আমার খামারে ২৩৫টি ছোট-বড় ভেড়া রয়েছে। তাদের বিচরণের জায়গা কমে যাওয়ায় আগের মত খাদ্য পাওয়া যায় না। এছাড়া মাঝে মধ্যে দু-একটি ভেড়া চুরি হয়ে যায়, অসুখে মারা যায়। তারপরও লাভজনক হওয়ায় এ পেশা ধরে রেখেছি।
আরেক খামারি মো. সাব্বির বলেন, আমার কাছে ১৩০টি ভেড়া রয়েছে। আগে আরো বেশি ছিল। সরকারিভাবে জায়গা অধিগ্রহণের কারণে বিচরণভূমি কমে গেছে।
উপজেলার ডোমখালী আরবিসি এগ্রো ট্যুরিজমের ম্যানেজার রাশেদ নুর বলেন, আমাদের খামারে এক সময় ১০০ ভেড়া ছিল। এখন ১৫ থেকে ১৬টি রয়েছে। কিছু বিক্রি করে দিয়েছি এবং রোগে অনেক ভেড়া মারা গেছে। আবার গত দুই বছর কোরবানে বিক্রি করেছি অনেক ভেড়া।
মিরসরাই উপজেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের হিসেব অনুযায়ী ২০২০ সালে উপজেলায় ৩৯৭৭ টি ভেড়া ছিল। ২০২১ সালে ছিল ৩৮০২ টি। ২০২২ সালে ৩৭০৬টি। ২০২৩ সালে ভেড়ার সংখ্যা কমে হয়েছে ২৪৭৫টি।
ইছাখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুল মোস্তফা বলেন, আমার ইউনিয়নের অনেক লোক রয়েছে যাদের পেশা চরে পশু পালন। যুগের পর যুগ তাঁরা এ পেশায় জড়িত। পশু পালন করে তাঁরা স্বাবলম্বী। এখনো অনেকে ভেড়া পালন করছেন। তবে আগে থেকে কমে যাচ্ছে। শিল্পনগর গড়ে উঠার কারণে অনেক জায়গা চলে গেছে। পশুগুলো বনবিভাগের জায়গায় গেলে তাঁরাও বাঁধা দেয়। আমি সংশ্লিষ্টদের কাছে অনুরোধ করবো, ইছাখালী চরে জায়গার অভাব নেই। নির্দিষ্ট কিছু জায়গা পশু পালনের জন্য যেন উন্মুক্ত রাখা হয়।
মিরসরাই উপজেলা প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তা ডা. জাকিরুল ফরিদ বলেন, মিরসরাইয়ের চরাঞ্চলে ভেড়া পালন করে অনেক পরিবার স্বাবলম্বী। এখন উপজেলার পাহাড়ি এলাকায় ভেড়া পালন করছেন। উপজেলার করেরহাট ইউনিয়নে ভেড়া পালন করছেন কয়েকজন খামারি। তিনি আরো বলেন, বর্তমানে উপজেলায় ২৪৭৫ টি ভেড়া রয়ছে। আমরা প্রতি বছর এলাকা হিসেবে গননা করে থাকি।