
ইছাখালীর সমুদ্র উপকুলে চলছে বিশাল কর্মযজ্ঞ। একের পর এক গড়ে উঠছে শিল্পকারখানা। নির্মাণ হচ্ছে অবকাঠামো সহ নানা স্থাপনা। সাগরপাড়ে জেগে উঠা চর আর পতিত জমিতে গড়ে উঠা দেশের বৃহৎ শিল্প নগরে কেবল কারখানা চালুর অপেক্ষা। আগামী মার্চে দেশের বৃহৎ উন্নয়ন প্রকল্প বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগরে চালু হচ্ছে দুটি কারখানা। এতে রং এবং এমএস প্লেট উৎপাদন করতে ২০ মিলিয়ন করে মোট ৪০ মিলিয়ন ইউএস ডলার বিনিয়োগ করেছে প্রতিষ্ঠান দুটি।
চট্টগ্রামের মিরসরাই, সীতাকুন্ড ও ফেনীর সোনাগাজীতে ৩০ হাজার একর জমিতে গড়ে ওঠা দেশের বৃহত্তম শিল্পনগর আগামী মার্চ থেকে উৎপাদন শুরু করছে বাংলাদেশের ম্যাগডোনাল্ড স্টিল এবং ভারতের এশিয়ান পেইন্টস।
এই প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) আবদুল্লাহ আল মাহমুদ ফারুক জানিয়েছেন, চলতি বছরের মার্চে প্রথমবারের মতো উৎপাদন শুরু করতে যাচ্ছে এশিয়ান পেইন্টস। প্র্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই কারখানা উদ্বোধনের কথা রয়েছে। এছাড়াও আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের নির্মাণ কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “বাংলাদেশের বড় ধরনের পরিবর্তনের কর্মযজ্ঞ চলছে এই শিল্প নগরে। প্রথম কারাখানা উৎপাদনে যাওয়া দেশের অর্থনীতির জন্য বড় ধরনের সুখবর। এই প্রকল্পে যারা জমি বরাদ্দ নিয়েছেন তাদের অনুরোধ জানাবো তারা যেন দ্রæত কারখানা নির্মাণ কাজ শুরু করে।”
এশিয়ান পেইন্টস সুত্র জানায়, ২০ একর জায়গা জুড়ে এশিয়ার সবচেয়ে বড় রং তৈরীর কারখানা স্থাপন করেছে এশিয়ান পেইন্টস। এই কারখানায় রং এবং এর অন্যান্য উপকরণ তৈরী করা হবে।
ম্যাকডোনান্ড স্টিল এর প্রজেক্ট ম্যানেজার আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, “১০ একর জমিতে ১১৪ কোটি টাকা বনিয়োগে স্টিল কারখানা নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ। আগামী মার্চে আমরা এই কারখানায় উৎপাদন শুরু করতে পারবো বলে আশা করছি। এই কারখানায় এমএস প্লেট তৈরী করা হবে।” কারখানায় ৬২ জন লোকের কর্মসংস্থান হবে বলে জানান তিনি।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পুরোদমে চলছে বেশকিছু শিল্প-প্রতিষ্ঠানের নির্মাণকাজ। এদিকে পাথরের স্তুপ তো ওদিকে ইটের স্তুপ। আবার কোন দিকে চোখে পড়ে বালি, খোয়া, রড, স্টীরের স্তুপ। একেকটি প্রতিষ্ঠান নির্মাণে কাজ করছে ’শ তিনেক করে লোক। তারা যে যার কাজে ব্যস্ত। নেই দম ফেলার ফুসরত। একাধিক খনন যন্ত্র, ভরাট যন্ত্রে চলছে অবিরাম কাজ। তৈরি হচ্ছে কাঁচামাল রাখার গোডাউন, পাম্প হাউজ, অফিস, প্রশাসনিক ভবন।
কারখানা নির্মাণের জন্য পূর্বশর্ত হলো বরাদ্ধকৃত প্লটগুলো কারখানা নির্মাণের উপযোগী করে প্রস্তুত করা। বেজার দাবী, জোরেশোরেই চলছে প্লটের অবকাঠামো নির্মানের কাজ।
ইতোমধ্যে বেশ কিছু প্লট সম্পূর্ণ প্রস্তুত। যাতায়াত, গ্যাস, বিদ্যুৎ সহ যাবতীয় উপযোগ সুবিধা নিশ্চিত হয়েছে কয়েকটি প্লটে। এ প্লটগুলো কারখানা নির্মাণের জন্য প্রস্তুত।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশে শিল্পের বিকাশে এটি বিশাল মাইলফলক। সমুদ্র তীরবর্তী জেগে উঠা চর এবং পতিত জমি কাজে লাগিয়ে শিল্পাঞ্চল গড়ার স্বপ্ন এখন বাস্তবে রুপ নিচ্ছে। পুরো প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ১৫ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
স¤প্রতি, মিরসরাই প্রেস ক্লাবের দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে মিরসরাইয়ের সাংসদ ও মিরসরাই ইকোনোমিক জোনের স্বপ্নদ্রষ্টা ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বলেন, ৩০ হাজার একরের এ শিল্পাঞ্চলে কর্মসংস্থান হবে প্রায় ১৫ লক্ষ মানুষের। মিরসরাইয়ের মানুষ আর বেকার থাকবেনা। এখানে চাকুরীর ক্ষেত্রে মিরসরাইয়ের জনগণ অগ্রাধিকার পাবে। তবে শিক্ষা ও দক্ষতার কোন বিকল্প নেই। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চাকুরী পাওয়ার পূ‚র্বশর্ত হিসেবে তিনি মিরসরাইয়ের জনগনদের প্রতি দক্ষতা অর্জনের আহবান জানান।
এমপিপুত্র বিশিষ্ট আইটি বিশেষজ্ঞ মাহবুবুর রহমান রুহেল বলেন, মিরসরাই হবে আগামীর সিঙ্গাপুর। মিরসরাইয়ের জনগণকে শ্রমবাজারে দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে উপজেলাজুড়ে বেশ কিছু টেকনিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হবে।
বেজা সুত্র জানায়, বর্তমানে প্রায় ৬ হাজার একর জমি ইতোমধ্যে মাটি দিয়ে ভরাট করা হয়েছে। বর্তমানে সড়ক, সেতুসহ অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে। কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন নির্মাণাধীন কারখানায় গ্যাস ও বিদ্যুতের লাইন বসিয়ে দিচ্ছে। এছাড়াা শিল্পনগরীর ভেতরে রাস্তার জন্য সোলার সিস্টেম স্থাপন করা হয়েছেছে।
এশিয়ান পেইন্টস এবং ম্যাকডোনাল্ড স্টিল ছাড়াও, হেলথকেয়ার ফার্মাকে ৪০ একর, বাংলাদেশ অটো ইন্ডাস্ট্রিজকে ১০০ একর, এসকিউ ক্যাবলকে ৪০ একর, জিংউয়ানকে ১০ একর, মডার্ন সিনটেক্সকে ২০ একর, নিপ্পন এবং ম্যাকডোনাল্ড স্টিলকে ১০০ একর ও বার্জার পেইন্টসকে ৩০ একর জমিতে তাদের কাজ পরিচালনা করতে দেখা গেছে।
এছাড়া সমুদা ফুডস এবং বার্জার পেইন্টস আগামী বছরের (২০২৩) মধ্যে তাদের কারখানা চালু করার পরিকল্পনা করছে। বিশেষ জোনগুলোর মধ্যে, ১ হাজার ১৫০ একরের বেপজা অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণকাজ শুরু করেছে। অন্যদিকে ৫০০ একরের বিজিএমইএ গার্মেন্ট ভিলেজ এবং ৫০০ একরের এসবিজি অর্থনৈতিক অঞ্চলেও মাটি ভরাট করে কারখানা নির্মানের উপযোগী করা হয়েছে। বসুন্ধরা গ্রæপ দ্রæতই তাদের ৫০০ একরের জোন প্রস্তুত করছে।
বেজার সহকারী প্রকৌশলী ফেরদৌস ওয়াহিদ বলেন, “আমরা ইতোমধ্যেই নির্মাণাধীন কারখানার জন্য গ্যাস ও বিদ্যুৎ নিশ্চিত করেছি। আপাতত কারখানাগুলোতে ভুগর্ভস্থ পানি সরবরাহ করা হবে। ।”
মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলে দেশি-বিদেশি অনেক নামীদামি প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ করছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে রয়েছে জাপানের নিপ্পন, ভারতের এশিয়ান পেইন্টস, যুক্তরাজ্যের বার্জার পেইন্টস ও সিঙ্গাপুরের উইলমার। আর দেশি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে পিএইচপি, বসুন্ধরা গ্রæপ ও টিকে গ্রæপ।
বার্জার বাংলাদেশ এখানে তাদের তৃতীয় এবং সবচেয়ে বড় কারখানা স্থাপন করতে চায়। এ জন্য তারা বিনিয়োগ করবে ২০০-২৫০ কোটি টাকা, যে কারখানার কাজ ৫ বছরের মধ্যে সমাপ্ত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
উত্তরা মোটরস লিমিটেড এই শিল্পনগরে গাড়ি অ্যাসেম্বলিং ও প্রস্তুতের জন্য গত ২৪ মার্চ ৫০ একর উন্নত জমির ইজারা চুক্তি করেছে। প্রতিষ্ঠানটি এখানে ৩৩ দশমিক ৬৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের মাধ্যমে সুজুকি ব্র্যান্ডের গাড়ি অ্যাসেম্বলিং ও প্রস্তুতের পরিকল্পনা করেছে।
দেশি-বিদেশি আরও যেসব প্রতিষ্ঠান এখানে বিনিয়োগ করে জমি বরাদ্দ পেয়েছে, সেগুলোর মধ্যে আছে বেইজিং ঝেনুয়ান হেংহুই ইঞ্জিনিয়ারিং কনসাল্টিং কোম্পানি, পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি, বিএসএ ফ্যাশনস লিমিটেড, হাংঝু ঝিনঝিয়াং গ্রæপ, ঝিন্দে ইলাস্টিক (বিডি), এক্সপোর্ট কম্পেটিটিভনেস ফর জবস, ইস্ট এশিয়ান কক্স, কমফিট কম্পোজিট নিট, ইওন মেটাল ইন্টারন্যাশনাল, ট্রেড ডিজাইন সল্যুশনস, ইয়নমেটাল লিমিটেড, ফন ইন্টারন্যাশনাল ও আরব বাংলাদেশ ফুডস লিমিটেড। এ ছাড়া বরাদ্দ পেয়েছে গ্যাস ওয়ান লিমিটেড, অনন্ত অ্যাপারেলস লিমিটেড, বিপি-পাওয়ারজেন লিমিটেড, এসিআই লিমিটেড, ইনট্রিগা অ্যাপারেলস লিমিটেড, হ্যামকো করপোরেশন লিমিটেড, যমুনা স্পেসটেক (জেভি) লিমিটেড, বিএসআরএম স্টিল মিলস লিমিটেড, চিটাগং পাওয়ারসহ অনেক প্রতিষ্ঠান
।
উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর তথা মিরসরাই ইকোনোমিক জোন দেশের সর্ববৃহৎ ও দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহত্তম শিল্পনগরী। এটি চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার ইছাখালী ইউনিয়নের সাধুরচর, শীলচর, মোশাররফচর ও পীরেরচর এবং ফেনীর সোনাগাজী ও চট্টগ্রামের সীতাকুÐ অংশের বিস্তীর্ণ চরাঞ্চলের ৩০ হাজার একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত।