- মোহাম্মদ ইউসুফঃ
পাহাড় থেকে আনা বাঁশ দিয়ে আগে লাই, খাচি, টুকরি সহ বিভিন্ন হস্তশিল্প তৈরী করতেন বিবি ফাতেমা, জেসমিন আক্তার মনি, আমেনা আক্তার সহ গ্রামীণ নারীরা। পাহাড়ে বাঁশের যোগান কমে যাওয়ায় ও অল্পদামে প্লাস্টিকের তৈরী পণ্য পাওয়ায় গ্রাহকের অভিরুচিও পরিবর্তন হয়েছে। বিভিন্ন কারখানার যন্ত্রাংশের বাস্ক, লোহার স্প্রিণ ব্লেড ও তুলার গাইডে ব্যবহৃত প্লাস্টিক দিয়ে মিরসরাইয়ের গ্রামীণ নারীরা তৈরী করছেন ছোট বড় টুকরী সহ হাতের কারুকাজের তৈরী প্লাস্টিকের পণ্য। দামে কম মানে ভালো এসব পণ্য বিক্রি করে স্বাবলম্বী হয়েছেন মিরসরাই উপজেলার ২নং হিঙ্গুলী ইউনিয়নের প্রায় পাঁচ শতাধিক নারী।
জানা গেছে, উপজেলার হিঙ্গুলী ইউনিয়নের দক্ষিণ মেহেদীনগর, উত্তর মেহেদীনগর ও স্টেশন গ্রামের অধিকাংশ পরিবারই আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল। আগে শিতল পাটি বুনা ও বাঁশ থেকে তৈরী বেত দিয়ে বিভিন্ন হস্তশিল্প তৈরী করে সংসার চালাতেন নারীরা। যা দিয়ে পরিবারের ভরণ পোষণে কিছুটা হলেও আর্থিক ভূমিকা রাখতে পারতেন তারা। এখন শিতল পাটির প্রধান কাঁচামাল পাটি বেত ও পাহাড়ে সামাজিক বনায়নের ফলে বাঁশের উৎপাদন কমে যাওয়ায় আগের মতো বাঁশ পাওয়া যায় না। বিগত ৮-১০ বছর পূর্বে মেহেদী নগর গ্রামে প্লাস্টিকের বেত দিয়ে বিভিন্ন সাইজের টুকরি, হাতপাখা, ঢালা, লাই সহ বিভিন্ন পণ্য তৈরীর কাজ শুরু করেন কয়েকজন উদ্যোক্তা। প্রথমে কয়েকটি পরিবার ক্ষুদ্র আকারে প্লাস্টিকের বেত দিয়ে টুকরি তৈরীর কাজ শুরু করলেও এখন তা হিঙ্গুলী ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে ছড়িয়ে গেছে। গ্রামের মহিলার পারিবারিক কাজ শেষ করে অবসর সময়ে প্লাস্টিকের টুকরি তৈরীর কাজ করেন। পাইকাররা প্লাস্টিকের বেত সরবরাহ করেন; সেই বেত দিয়ে বিভিন্ন সাইজের টুকরি তৈরী করে আবার পাইকারদের কাছে দেন তারা। ছোট টুকরি ১৭ টাকা, মাঝারি টুকরি ২৫ টাকা, বড় টুকরি ৬০ টাকা মজুরিতে কাজ করেন তারা। প্রতিদিন ১৫-২০টি টুকরি তৈরী করতে পারেন একজন নারী। প্রতি সপ্তাহে সাড়ে ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার টাকা আর মাসে প্রায় ১২ হাজার টাকা আয় করেন একজন নারী। পাইকাররা নারীদের হাতে তৈরী প্লাস্টিকের টুকরি ২-৩দিন পরপর সংগ্রহ করে বিভিন্ন মাছের আড়ৎ, সবজির পাইকারী বাজার সহ ঢাকা-চট্টগ্রামের বিভিন্ন বড় বাজারে নিয়ে গিয়ে তা বিক্রী করেন। তবে নারীদের কোন পুঁজি না থাকায় পাইকাররা তাদের অল্প মজুরি দিয়ে বেশী দামে টুকরি বাজারে বিক্রির করার অভিযোগ করেন কেউ কেউ। তাদের যদি সরাসরি সরকারি প্রণোদনা দেওয়া যায় তাহলে তারা লাভবান হবেন টুকরি বিক্রি করে।
উদ্যোক্তা মো. জসিম উদ্দিন জানান, মেহেদীনগর গ্রাম থেকে প্রতি মাসে প্রায় ২০ লাখ টাকার টুকরি দেশের বিভিন্ন বাজারে বিক্রির জন্য নেওয়া হয়। প্লাস্টিকের বেতের তৈরী টুকরিগুলো দিয়ে মাছ, সবজি কাঁচামাল সহ অন্যান্য দ্রব্যাদি একস্থান থেকে অন্যস্থানে সহজে প্রেরণ করা হয়। টুকরিগুলো অনেক টেকসই এবং দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় অনেকদিন ব্যবহার করা যায়।
স্থানীয় জেসমিন আক্তার মনি বলেন, তিনি বিগত তিন বছর যাবৎ পাইকার থেকে প্লাস্টিকের বেত নিয়ে তা দিয়ে বিভিন্ন সাইজের টুকরি বানিয়ে মজুরি নেন। প্রতিদিন ১৫-২০টি বড় টুকরি তৈরী করেন। দৈনিক মজুরী পান গড়ে ৫’শ থেকে ৬’শ টাকা। যা দিয়ে সংসারের খরচ চালাতে আর্থিকভাবে তিনিও স্বামীকে সহায়তা করতে পারেন।
বিবি ফাতেমা বলেন, স্বামীও ৩ ছেলে নিয়ে তার সংসার। সাংসারিক কাজ শেষে প্রায় সময় অলস সময় কাটাতে হয়। তাই গ্রামের নারীদের থেকে প্লাস্টিকের টুকরি বানানো শিখে তিনিও বিগত ২ বছর যাবৎ টুকরি বানানোর কাজ করছেন। বর্তমানে দ্রব্যমূল্যের অসহনীয় দামের মধ্যে যা দিয়ে কিছুটা হলেও সংসারের খরচ মেটাতে স্বামীকে সহায়তা করতে পারেন তিনি।
সানজিদা আক্তার উর্মি বলেন, বাবা-মা ও তিন বোন নিয়ে তাদের সংসার। বাবা স্থানীয় একটি হোটেলে কাজ করেন। বোনদের বিবাহ দেওয়া ও বাড়িতে ঘর তৈরী করার সময় এনজিও ও স্থানীয়দের থেকে সুদের উপর টাকা নিয়ে অনেক টাকা ঋণ করেন তার বাবা। পরবর্তীতে সে টাকা শোধ করার জন্য প্লাস্টিকের বেত দিয়ে তারা বিভিন্ন টুকরি বানানোর কাজ শুরু করেন। স্থানীয় পাইকারী মো. জসিম উদ্দিন থেকে প্লাস্টিকের বেত নিয়ে মা আর দুই বোন মিলে প্রতিদিন ২০টি টুকরি তৈরী করেন। যার মজুরী হিসেবে দৈনিক ৬’শ টাকা পান। অভাব অনটনের সংসারে ওই অর্থ দিয়ে ঋণ শোধ করার পাশাপাশি স্বচ্ছলতার সহিত চলছে এখন তাদের সংসার।
উদ্যোক্তা মো. জসিম উদ্দিন বলেন, মেহেদীনগর গ্রামের নারীরা আগে পাটি বেত ও বাঁশ দিয়ে তৈরী বিভিন্ন হস্তশিল্প তৈরী করতেন। কালের বিবর্তনে পাটি বেত আর বাঁশের তৈরী পণ্যের জায়গা দখল করেছে প্লাস্টিকের বেতের তৈরী পণ্য। ঢাকার গাজীপুর, গাউছিয়া, কাঁচপুর এলাকার বিশ^রোড, চট্টগ্রামের ফুড কলোনী, লেবার কলোনী সহ বিভিন্ন জায়গা থেকে পাইকারীতে প্লাস্টিকের বেত প্রতি কেজি ৩০-৫০ টাকায় কিনে নিয়ে আসেন। যা প্যাক্টরির পণ্য, তুলার গাইড, লোহার স্প্রিণ বেল্ড হিসেবে লাগানো থাকলেও পরবর্তীতে ওই বেত বাজারে বিক্রি করে দেওয়া হয়। বিভিন্ন বাজার থেকে তা খুঁজে খুঁজে কিনে নিয়ে আসেন পাইকাররা। পরবর্তীতে তা দিয়ে টুকরি সহ বিভিন্ন পণ্য তৈরীর জন্য গ্রামের নারীদের কাছে সরবরাহ করেন। তার অধীনে ২০ জন নারী কাজ করেন বলে জানান। আকার ভেদে প্রতিটি টুকরি ১৫০ টাকা থেকে ৫’শ টাকা পর্যন্ত বাজারে বিক্রি করা হয়। মেহেদী নগর গ্রামে ৫ জন পাইকারীর অধীনে প্রায় ৫ শতাধিক নারী প্লাস্টিকের বেত দিয়ে টুকরি তৈরীর কাজ করেন বলে জানান তিনি।
তিনি আরো বলেন, প্লাস্টিকের বেত দিয়ে তৈরী হস্তশিল্পটির জন্য আমরা ব্যাংক থেকে কোন ঋণ পায় না। স্থানীয় এনজিও থেকে বেশী সুদে ঋণ নিতে হয়। তাও ২০ হাজার টাকার বেশী ঋণ দেয় না। প্রতি সপ্তাহে এনজিওগুলো ঋণের টাকা সংগ্রহ করার ফলে ব্যবসায় তেমন লাভ হয় না। মাস শেষে ঋণের টাকা সংগ্রহ করলে আমাদের জন্য উপকার হতো। ব্যাংক থেকে বড় আকারের ঋণ নিতে পারলে বেশী পরিমাণে প্লাস্টিকের বেত কিনে ব্যবসার পরিধি আরো বাড়ানো সম্ভব বলে জানান তিনি।
স্থানীয় ৬নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য শহীদুল ইসলাম রানা বলেন, দক্ষিণ মেহেদীনগর, উত্তর মেহেদীনগর, স্টেশন রোডে তার অধীনে প্রায় দেড় শতাধিক নারী প্লাস্টিকের বেত দিয়ে টুকরি তৈরীর কাজ করেন। যারা প্রতিটি টুকরি তৈরীতে গড়ে ১৭ টাকা থেকে ৬০টাকা পর্যন্ত মজুরী পান। আর প্রতিটি টুকরি তিনি আকার ভেদে ১’শ টাকা থেকে ৫৫০টাকায় বিক্রি করেন বিভিন্ন পাইকারী দোকানে। টুকরি তৈরী করে ইউনিয়নের প্রায় ৫’শতাধিক মহিলা স্বাবলম্বী হয়েছেন বলে দাবী করেন তিনি। সরকারি পৃষ্টপোষকতা ও ব্যাংক থেকে অল্প সুদে ঋণ পেলে ব্যবসার পরিধি আরো বাড়ানো সম্ভব বলে জানান তিনি।
উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা মেহের আফরোজ বলেন, আমাদের মা-বোনেরা সংগ্রামী জীবন পালন করেন। প্লাস্টিকের বেত দিয়ে টুকরি তৈরী করে তারা যেভাবে স্বাবলম্বী হয়েছেন সেটি সত্যি প্রশংসনীয়। আমি মেহেদীনগর গ্রাম পরিদর্শন করবো এবং সহজ শর্তে তাদের সরকারী ঋণ ও ব্যাংক ঋণ পাইয়ে দিতে সহায়তা করবো।
হিঙ্গুলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সোনা মিয়া বলেন, ইউনিয়নের প্রায় ৫ শতাধিক মহিলা প্লাস্টিকের বেত দিয়ে টুকরি তৈরী করে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়েছেন। গ্রামের বেশীর ভাগ মহিলা বিভিন্ন এনজিও থেকে বেশী সুদে ঋণ নিয়ে জর্জরিত। তফশীলি ব্যাংক ও সরকারি বিভিন্ন সংস্থা যদি তাদের সহজ শর্তে ঋণ এবং আর্থিক প্রণোদনা দেয় তাহলে টুকরি তৈরীর পরিমাণ আরো বেড়ে যাবে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মিনহাজুর রহমান বলেন, সরকারি কয়েকটি দপ্তর থেকে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ঋণ দেওয়া হয়ে থাকে। আমি মেহেদীনগর গ্রামের নারীদের টুকরি তৈরীর বিষয়টি সরেজমিন পরিদর্শন করে সরকারীভাবে আর্থিক সহায়তার উদ্যোগ গ্রহণ করবো।