মোহাম্মদ ইউসুফ
হাইলাইটস
২ বছরের মধ্যে ফল আসে, প্রতিটি গাছে থোকায় থোকায় ঝুলছে গোল মরিচ
প্রতি কেজি শুকনো গোল মরিচ বিক্রি হয় ৫’শ থেকে ৬’শ টাকা
চলতি বছর ২ লাখ চারা বিক্রি করার টার্গেট
প্রতিটি চারা বিক্রি হয় ২০ থেকে ২৫ টাকা
পাহাড়বেষ্টিত মিরসরাই উপজেলার করেরহাট ইউনিয়নের কয়লা গ্রামের অধিকাংশ বাসিন্দার প্রধান পেশা ছিলো কাঠ কাটা, বাঁশ কাটা। যার ফলে উজাড় হয়ে যেতো বনাঞ্চল। পাহাড়ে বসবাসকারী ক্ষুদ্রনৃগোষ্ঠী ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের পুরুষরা ছোলাই মদ তৈরী ও বিক্রির সাথে সম্পৃক্ত ছিলো। তাদের দৈনন্দিন জীবনে গত তিন বছরে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে মূল্যবান মসল্লা গোল মরিচ চাষের ফলে। গত বছর ২০টি প্লট থেকে ৬’শ টাকা কেজি ধরে প্রায় ৭০ কেজি গোল মরিচ ৪২ হাজার টাকায় বিক্রি করা হয়। এবছর ফলন বেশী হওয়ায় সাড়ে ৩ হাজার কেজি শুকনো গোল মরিচ উৎপাদনের লক্ষমাত্রা রয়েছে। যার বাজার মূল্য প্রায় ২১ লাখ টাকা।
জানা গেছে, ২০১৭ সালের জুলাই মাসে বিশ জন কৃষককে প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে সমাজ উন্নয়ন সংস্থা অপকা’র সহযোগীতায় ও দাতা সংস্থা পিকেএসএফের আর্থিক সহায়তায় মিরসরাইয়ের করেরহাট ইউনিয়নের কয়লা গ্রামে ১১টি প্লট ও ফটিকছড়ি উপজেলার দাঁতমারা ইউনিয়নে ৯টি প্লটে বাণিজ্যিক ভাবে গোল মরিচ চাষ শুরু করা হয়। প্রশিক্ষণের পাশাপাশি অপকা’র পক্ষ থেকে গোল মরিচের চারা, খুঁটি ও প্রয়োজনীয় কীটনাশক সরবরাহ করা হয় কৃষকদের মাঝে। ২০টি প্লটে এখন গোল মরিচের ফল এসেছে। প্রতিটি গাছে গলার পুতি মালার মতো ফল ধরেছে। গত বছরও অনেক কৃষক গোল মরিচ বিক্রি করেছেন। প্রতি কেজি গোল মরিচ ৫’শ থেকে ৬’শ টাকায় স্থানীয় বাজারে বিক্রি করা হয়। এবছর কাঁচা গোল মরিচ প্রায় ১০ হাজার কেজি উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। শুকানোর ফলে যা প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কেজিতে রূপান্তরিত হবে। ৬’শ টাকা কেজি ধরে যার মূল্য দাঁড়ায় ২১ লাখ টাকা।
জানা গেছে, গোল মরিচ সাধারণত পাহাড়ের ঢালু ও আধাছায়াযুক্ত মাটিতে বেশী চাষ হয়। ২৫ শতক জায়গা নিয়ে প্রতিটি প্লট প্রস্তুত করা হয়। যেখানে ১টি খুঁটিতে ৪টি চারা গাছ লাগানো হয়। ১২৫ টি খুঁটিতে ৫’শ গোল মরিচের চারা লাগানো হয়ে থাকে। রোপনের ২ বছর পর ফল আসতে শুরু করে। প্রতিটি গাছের সঠিক পরিচর্যা করা গেলে ২০ থেকে ২৫ বছর পর্যন্ত ফল পাওয়া সম্ভব বলে জানা যায়। প্রতি ৪টি গাছ থেকে প্রত্যেক বছর ৭ থেকে ৮ কেজি কাঁচা গোল মরিচ পাওয়া যায়। সিদ্ধ করে শুকানোর পর যা ৩ থেকে ৪ কেজি ওজনের হয়। ফল আসার পর পাকতে (পরিপক্ক) হতে ৬ মাস লেগে যায়। গাছের বয়স ২ বছর হওয়ার পর প্রতিটি গাছ থেকে লতা কেটে কাটিং করা হয়। প্রতিটি কাটিং চারা খুচরা ২০ থেকে ২৫ টাকা বিক্রি করা হয়। ২৫ শতকের একটি প্লট থেকে প্রতি বছর ১০ হাজার চারা বিক্রি করা সম্ভব।
স্থানীয় গোল মরিচ চাষীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বাণিজ্যিকভাবে গোল মরিচ চাষে সফল হলেও তারা সরকারী সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। স্থানীয় কৃষি উপ-সহকারি কর্মকর্তা মাঝে মধ্যে গোল মরিচের ক্ষেত পরিদর্শনে গেলেও তাদের প্রশিক্ষণ কিংবা কীটনাশক দেয় না। করেরহাট ইউনিয়ন ও দাঁতমারা ইউনিয়ন দু’টির বেশীর ভাগ অংশ পাহাড়বেষ্টিত হওয়ায় শুষ্ক মৌসুমে পানির লেয়ার শুকিয়ে যায়। ফলে পানি সংকটের কারণে গাছ মারা যায়। এজন্য গভীর নলকূপ স্থাপন করা প্রয়োজন। গোল মরিচ পাকার পর তা সিদ্ধ করে পুনরায় শুকাতে অনেক সময় লেগে যায়। সরকারিভাবে যদি বয়লার মেশিন বসানো যায় তাহলে দ্রæত সময়ে গোল মরিচ বিক্রির উপযোগী করা সম্ভব। এছাড়া চারা বিক্রি করার জন্য একটি নার্সারী প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি সরকারিভাবে চারা ক্রয় করা হলে সারা দেশে গোল মরিচের চাষ করা সম্ভব বলে জানান তারা।
কৃষক রুহুল আমিন বলেন, কয়লা গ্রামের অধিকাংশ এলাকা পাহাড়বেষ্টিত। সমতল জমিতে ধান চাষ ছাড়া পাহাড়ে কোন ফসল হতো না। আমি গোল মরিচ চাষের প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর ২৫ শতক জমিতে চাষ করি। গোল মরিচের পাশাপাশি সাথী ফসল হিসেবে আধা, হলুদ, লাল শাকও মূলার শাকও চাষাবাদ করি। গোল মরিচের চারা রোপনের ২ বছর পর ফল আসে। আষাড়-জৈষ্ঠ্য মাসে ফুল ধরে, মাঘ মাসে ফল পাকে। আমি গত বছর ৫’শ টাকা কেজি ধরে ১০ কেজি শুকনো গোল মরিচ বিক্রি করেছি। এটি ঝাঁজ বেশী হওয়ায় স্থানীয় মসল্লার দোকানে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। অন্যান্য ফসলের থেকে এটির রোগবালাই কম। বর্ষাকালে মাটি অতিরিক্ত ভেজা থাকলে ছত্রাক ধরে গাছের গোড়া পঁচে যায়। এছাড়া শুষ্ক মৌসুমে নিয়মিত পানি দিতে না পারলে পাতা হলুদ হয়ে গাছ মারা যায়। সঠিকভাবে পরিচর্যা করলে গোল মরিচ চাষ করে লাভবান হওয়া সম্ভব বলে জানান তিনি।
গোল মরিচ চাষী শ্রীকান্ত ত্রিপুরা বলেন, পাহাড়ের ঢালুতে গোল মরিচের ফলন বেশী হলেও শুষ্ক মৌসুমে পানি সংকটের কারণে গাছ মরে যায়। এজন্য এখানে গভীর নলকূপ স্থাপন করা হলে গোল মরিচ চাষ আরো বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে। এছাড়া গোল মরিচ পাকার পর তা সিদ্ধ করে পুনরায় শুকানোর প্রয়োজন হয়। গোল মরিচ শুকানেরা জন্য একটি বয়লার মেশিন স্থাপন করা হলে চাষীদের অনেক উপকার হবে। তিনি গত বছর ৬’শ টাকা করে ৫ কেজি শুকনো গোল মরিচ বিক্রি করেছেন বলে জানান।
সমাজ উন্নয়ন সংস্থা অপকা’র নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ আলমগীর বলেন, মিরসরাই উপজেলার করেরহাট ইউনিয়ন ও ফটিকছড়ি উপজেলার দাঁতমারা ইউনিয়নটি পাহাড়বেষ্টিত হওয়ায় অনেক জায়গা অনাবাদি ছিলো। পাহাড়ের ঢালুতে গোল মরিচ চাষের জন্য পিকেএসএফের অর্থায়নে প্রথমে ২০ জন কৃষককে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ করা হয়। বাণিজ্যিকভাবে গোল মরিচ চাষে সফল হওয়ায় পরবর্তীতে আরো ১২’শ জন কৃষককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এখন করেরহাট ইউনিয়নে প্রায় ৩’শ কৃষক ব্যক্তিগতভাবে গোল মরিচ চাষ করছেন। গোল মরিচ বিক্রির পাশাপাশি প্রতি বছর চারা বিক্রি করে লক্ষাধিক টাকা আয় করা সম্ভব বলে জানান তিনি।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রঘুনাথ নাহা বলেন, পাহাড়ের ঢালুতে গোল মরিচ চাষ ভালো হয়। বিচ্ছিন্নভাবে পঞ্চগড়, শ্রীমঙ্গলে গোল মরিচ চাষ করা হলেও বাণিজ্যিক ভাবে মিরসরাইতে প্রথম গোল মরিচ চাষ করা হচ্ছে। স্থানীয় এনজিও অপকা কৃষকদের প্রশিক্ষণ, চারা বিতরণ সহ আনুসাঙ্গিক সরঞ্জাম বিতরণ করেছে। উপজেলা কৃষি অফিস থেকেও কৃষকদের বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। ইতমধ্যে গোল মরিচের ফলনও ভালো হয়েছে। গোল মরিচ চাষ করে অর্থনৈতিক সচ্ছলতা এসেছে স্থানীয় কৃষকদের। গোল মরিচ চাষকে পাইলট প্রকল্প হিসেবে সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া এবং কৃষকদের জন্য বয়লার মেশিন স্থাপন ও গভীর নলকূপ বসানোর বিষয়ে তিনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করবেন বলে জানান।