পলিতে বদলে যাচ্ছে নদীর গতি : কার্যকারিতা হারাচ্ছে সেচ প্রকল্প

top Banner
  • এম মাঈন উদ্দিন

ফেনী নদীতে বাস্তবায়ন হওয়া মুহুরী সেচ প্রকল্প কার্যকারিতা হারাচ্ছে। নদীর ভাটি এলাকায় জমে ওঠা পলির স্তরের কারণে নদীর স্বাভাবিক গতি বদলে যাচ্ছে। ২০১৯ সাল থেকে প্রতি বর্ষা মৌসুমে দফায় দফায় ভাঙ্গণের কবলে পড়েছে এখানকার সিডিএসপি বাঁধ, বিস্তীর্ণ এলাকা ও শত শত মৎস্য ঘের।

আসছে বর্ষায় এ পরিণতি আরো ভয়াবহ হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এছাড়া ভেস্তে যাবে ১৯৮৫-৮৬ অর্থ বছরে ১৬৮ কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়ন হওয়া মহুরী সেচ প্রকল্প।

স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসন বলছে, আগামী বর্ষা মৌসুমে বাঁধ ভেঙ্গে গেলে এখানে ভয়াবহ বিপর্যয় দেখা দিবে। পাশ্ববর্তী এলাকার মানুষ হারাবে ভিটেবাড়ি, কৃষক হারাবে জমি, নদী গর্ভে বিলীন হবে শত শত মৎস্য ঘের।

সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, প্রকল্পের ভাটিতে প্রায় ৭শ বর্গ মিটার এলাকা পলি জমে ৭৫ ভাগ ভরাট হয়ে গেছে । এতে নদীর পানি প্রবাহের পথ বদলে একদিকে ছোট ছোট চর জেগে উঠছে অন্যদিকে ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। আবার সেচ প্রকল্পের বেশ কিছু স্লুইজ গেট ইতোমধ্যে পলি জমার কারণে কার্যকারিতা হারিয়েছে।

মিরসরাইয়ের ওচমানপুর ইউনিয়নের স্থানীয় বাসিন্দা কামাল উদ্দিন জানান, ২০১৯ সালের শুকনো মৌসুমে প্রকল্পের ভাটির মুখে বালি ও মাটি জমাট শুরু হয়। ওই বছর বর্ষা শুরু হলে ভাঙ্গন দেখা দেয়। এরপর থেকে প্রতি বছর নদী গর্ভে বিলিন হচ্ছে ফসলি জমি ও মৎস্য ঘের। যা গত ৩৫ বছরেও এখানকার মানুষ দেখেনি। ইতোমধ্যে শতাধিক মৎস্য ঘের নদীতে বিলিন হয়ে গেছে।

এদিকে প্রতি বছর শুকনো মৌসুমে মুহুরী সেচ প্রকল্পের আওতায় চট্টগ্রামের মিরসরাই, ফেনীর সোনাগাজী ও ছাগলনাইয়া উপজেলার ২৭.১২৫ হেক্টর জমি ইরি চাষের আওতায় আসে। আশঙ্কা করা হচ্ছে ভরা বর্ষা শুরু হওয়ার আগে নদীতে পলি জমা এলাকা জরুরি ভিত্তিতে ড্রেজিং করা না হলে বিগত বছরগুলোর মতো এবারও একদিকে নদীর উজান এলাকার গ্রামের পর গ্রাম বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ হবে অপরদিকে এখানকার জমিগুলো অনাবাদি পড়ে থাকবে।

মিরসরাইয়ের ওচমানপুর ইউনিয়নের আজমপুর গ্রামের কৃষক নিজাম উদ্দিন বলেন, ‘আমরা নদীর আচরণ বুঝি। জমা হওয়া বালু মাটি খনন করলে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। গত ৩৫ বছর এখানে আমরা ভাঙ্গন দেখিনি। এখন বালু জমার কারণে ভাঙ্গন হচ্ছে।’

সিডিএসপি বাঁধ ভাঙ্গলে বিপর্যয়:
মিরসরাইয়ের বিস্তীর্ণ জনপদকে বঙ্গোপসাগরের ভাঙ্গণ থেকে রক্ষা করতে ১৯৯৪ সালে চর ডেভেলপমেন্ট এন্ড সেটেলমেন্ট প্রকল্পের (সিডিএসপি) আওতায় বাস্তবায়ন করা হয় ১১.৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে বাঁধ। এ বাঁধের কারণে এখানকার বাঁশখালী ও ইছাখালী এলাকায় গড়ে ওঠে হাজার হাজার একর মৎস্য ঘের। যা থেকে চট্টগ্রামের মৎস্য খাদ্য চাহিদার ৭০ ভাগ উৎপাদিত হয়।

ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, কয়েক বছর আগে সিডিএসপি বাঁধের কিছু অংশ ভেঙ্গে সাগরে বিলীন হয়ে যায়। ওইসময় ভেঙ্গে যাওয়া অংশ নদীর গতি প্রকৃতি বুঝে অন্য দিক দিয়ে ঘুরিয়ে নতুন করে নির্মাণ করা হয়।

এদিকে আশঙ্কা করা হচ্ছে জরুরি ভিত্তিতে সিডিএসপি বাঁধের পশ্চিম পাশে সুরক্ষা ব্লক না বসালে চলতি বর্ষা মৌসুমে বাঁধ ভেঙ্গে বড় ধরণের বিপর্যয় দেখা দিবে।

সরেজমিন সিডিএসপি বাঁধ এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বাঁধের উত্তর অংশের প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকা ফেনী নদীর অববাহিকায় অবস্থিত। বাকি অংশটুকু বয়ে গেছে বঙ্গোপসাগর অববাহিকায়। স্থানীয়দের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, একসময় নদী ও সাগর থেকে বাঁধের দূরত্ব ছিল প্রায় ৭শ মিটার। বর্তমানে কোথাও ১০মিটার আবার কোথাও ৫০ মিটার দূরত্ব রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, এবারের বর্ষা মৌসুমে গুরুত্বপূর্ণ এ বাঁধ ভয়াবহ ভাঙ্গনের মুখে পড়বে।

দেখা গেছে, বিভিন্ন সময় ভাঙ্গন রোধে সরকারের পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে সুরক্ষার জন্য সিসি ব্লক বসালেও বর্তমানে তা নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।

সিডিএসপি বাঁধের ভাঙ্গন প্রসঙ্গে মিরসরাই উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. জসিম উদ্দিন বলেন, ‘এলাকার লোকজন থেকে জেনে এটি আমি সরেজমিন গিয়ে দেখেছি। সেখানে ভয়ংকর অবস্থা। যে কোন সময় বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। এ বিষয়ে জরুরি পদক্ষেপ নিতে আমরা মাননীয় পানি সম্পদ মন্ত্রী ও সচিব বরাবরে ই-মেইলে একটি চিঠি দিয়েছি।’

এসব বিষয়ে কথা বলতে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ফেনীর উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. নুরুন নবী জানান, নদীর ভাটি এলাকায় জমে থাকা পলি ড্রেজিং এর জন্যে আমরা আরো আগে উদ্যোগ নিয়েছি। এ বিষয়ে একটি টেকনিক্যাল কমিটিও হয়েছে। প্রকল্পের ফিজিবিলিটি স্টাডির জন্য আমরা মন্ত্রনালয়ে অর্থ চেয়ে ইতোমধ্যে চিঠি দিয়েছি। টাকা পেলেই স্বক্ষমতা যাছাই শেষে মূল প্রকল্প সাবমিট করা হবে।

উল্লেখ্য, ফেনী, মুহুরী ও কালিদাস নদীর সম্মিলিত পানি প্রবাহকে সেচ কাজে লাগাতে এবং চট্টগ্রামের মিরসরাই ও ফেনীর সোনাগাজী ও ছাগলনাইয়া উপজেলা এলাকার বিস্তৃন্য জনপদকে বন্যা ও ভাঙ্গনের হাত থেকে রক্ষা করতে বাস্তবায়ন করা হয় মুহুরী সেচ প্রকল্প। ১৯৭৭-৭৮ অর্থবছরে শুরু হয়ে ১৯৮৫-৮৬ অর্থ বছরে এটির পূর্ণাঙ্গ কাজ শেষ হয়। ৪০টি স্লুইজগেট বিশিষ্ট এ প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় হয় ১৬৮ কোটি টাকা। যার অর্থায়ন করে সিডা, ইইসি ও বিশ্বব্যাংক।

আরো খবর