::সুবর্ণা চক্রবর্তী::
একদেশে ছিলো এক নাপিত আর নাপিতের বউ। নাপিত রাজার চুল, দাঁড়ি কাটে। তাই রাজার খুব কাছের লোক। নাপিতের বউ নামে সরলা হলে ও আসলে ছিল খুব ঝগড়াটে। কারো সাথে একবার ঝগড়া লাগলে সারাদিন তা নিয়েই লেগে থাকতো। সংসারের কাজে মনই থাকত না। একদিন নাপিত রাজার চুল কেটে বাড়ি আসলো। দেখলো, গিন্নীর তখনো রান্না হয়নি। এদিকে পেটে চরম ক্ষিদে। ভীষণ ক্ষেপে বলল- এতক্ষণ কী করলি? কার সাথে আজ ঝগড়া করলি? এতক্ষণেও ভাত রান্না হলো না। শুনে সরলা বলল, এই তুই-তোকারি ব্যবহার করবা না কইলাম। রাজবাড়িতেই তো গেলে, কিছু খেতে দেয়নি বুঝি তারা? এতে নাপিত এর রাগ আরো বেড়ে গেলো। দিলো চুলের মুঠি ধরে কয়েকটা চড়। চড় খেয়ে নাপিত বউ বলে- এতবড় সাহস মিনসে বুড়োর? আমার গতরে হাত তোলা? আমি এখনি যাব রানিমার কাছে। ভুইলা গেলে, রানি মা আমার ছোটবেলার সই? বলতে না বলতেই সরলা ছুটলো রাজবাড়ির দিকে।
রাজসভায় রাজা হাজির। বিচার কাজ শুরু হলো। রাজা মশাই সব শুনে বললেন- আমি সব বিবেচনা করে দেখলাম সব দোষ নাপিত বউয়ের। স্বামী কাজ করে বাড়িতে গেছে। তাকে সময় মত খেতে দেওয়া স্ত্রীর ধর্ম। আর স্ত্রীদের স্বামীরা মারলে তেমন দোষের কিছু না। স্বামীরা স্ত্রীদের মারবে এখানে কীসের বিচার? শুনে তো নাপিত বেটা মহাখুশি। কিন্তু নাপিত বউ সরলা কিছুতেই মানতে পারলো না বিচার। কাঁদতে কাঁদতে ছুটলো রানিমার কাছে অন্দরমহলে।
রানি মা আগে থেকেই পছন্দ করতো সরলাকে। কারণ সরলা খুব রসিকতা করে কথা বলে। আর সরলা ছিল রানির ছোটবেলার সই। অচিন রাজ্যে ছোটবেলায় ওরা কতই না খেলেছে। সব শুনে রানি মা বললেন- এটা তো রাজা মশাই ঠিক বিচার করেন নি। নারীর গায়ে হাত তোলা? এটাতো মানা যায় না। পুরুষগুলোকে তো একটা উচিত শিক্ষা দিতে হবে। কি বলিস, সরলা? সরলা বললো- ঠিকই বলেছেন রানি মা। স্ত্রী হলেও আমরা হইলাম নারী। নারী নির্যাতন কিছুতেই মানা যায় না। রানি মা রাজাকে ডেকে পাঠালেন অন্দরে। অন্দরে প্রবেশ করতেই রানি মা শুধালেন- এ কেমন বিচার করলেন রাজা মশাই? রাজা বললেন- ভালোই তো করেছি বিচার। রাগের মাথায় নাপিত বেটা না হয় তার বউকে মেরেছে। তাতে দোষের কিছু দেখছি না। রানি ক্ষেপে গিয়ে বললেন- আমি রানি শান্তিময়ী বেঁচে থাকতে রাজ্যে নারী নির্যাতন? ঠিক আছে, আজ থেকে কোনো স্বামী তার স্ত্রী এমনকি কোনো নারীর মুখ দর্শন করতে পারবে না। বউ ছেলের ভরণপোষণ দিতে হবে কিন্তু স্বামীদের জন্য কোনো রান্না স্ত্রীরা করবেনা। স্বামীরা আলাদা রান্না করে খাবে। রাজা বললেন- তবে তাই হোক। দেখি আপনারা কয়দিন পুরুষ ছাড়া থাকতে পারেন রানি শান্তিময়ী। রানি মা ও বললেন, আমরা ও দেখবো নারী ছাড়া পুরুষরা কয়দিন চলতে পারে।এমনকি কোনো পুরুষ নারীর দিকে তাকালে তার চোখ খুলে নেওয়া হবে। সরলা দৌড়ে এসে বললেন, যথার্থ বিচার রানি মা। রানি শান্তিময়ীর জয় হোক। রানি শান্তিময়ীর জয় হোক।
রাজ্যে ঘোষণা করা হলো, যদি কোনো পুরুষ নারীদের দিকে তাকাই তাহলে রানি মার হুকুমে তার চোখ তুলে নেওয়া হবে। এই ঘোষণা শুনে রাজ্যের লোক তো হতবাক ! এ আবার কেমন কথা? যেসব নারী নির্যাতনের স্বীকার তারা রানি মার প্রশংসা করতে লাগলো। পুরো কাহিনী শুনে রাজ্যের লোক নাপিত আর নাপিত বউকে দোষারোপ করতে লাগলো।
আজ তিনদিন হয়ে গেল। রাজা-রানির দেখা নাই। এদিকে আবার রানির রান্না ছাড়া রাজা খেতেই পারেন না।কী করা যায় ভাবতে লাগলো। রানি মা আঠারো পদের রান্না করে রাজাকে খাওয়াতে পারছে না বলে মনে কষ্ট লাগছে। তারপর ও ভাবছে, দেখি কয়দিন চলতে পারে। ওদিকে নাপিত বউ সরলা ও আছে নিজের মত করে ছেলেমেয়েদের নিয়ে। নাপিত বেটা সকালে বাজার করে দিয়ে ছেলেকে দিয়ে ভিতরে পাঠিয়ে দেয়। তারপর চুল কাটতে বের হয়। কাজ সেরে এসে বাইরের চুলোয় নিজের জন্য রান্না করে। আজ বেটা আগুনও ধরাতে পারছে না। ধোঁয়ার জন্য চোখ খুলতে পারছেনা। ঘরের ফুটো দিয়ে দেখলো সরলা। মনে মনে বলল, বুঝুক এবার বউয়ের গায়ে হাত তোলার মজা।
রাজ্যের সব পুরুষরা অতিষ্ঠ হয়ে রাজার কাছে গেলেন যেন এর সুবিচার করেন। তাদের সংসার আর চলছে না নারী ছাড়া। এভাবে সাতদিন কাটলো। রানির ও মন একটু একটু গলতে লাগলো। ভাবছেন, রাজা মশাই এর চাঁদ বদন মুখটা আজ সাতদিন দেখতে পারছি না। রাজাও ভাবছেন, আজ সাতদিন আমার শান্তিময়ীর রূপের ঝলকটা না দেখে বেঁচে আছি কী করে? ঐদিন বিকালে নাপিত বউ এলো রানি মার কাছে। রানি মা বলে ডাক দিতেই শান্তিময়ী বললেন, ‘জানি তো তোরও মন খারাপ লাগছে ওই নাপিত বেটার জন্য। কিন্তু আমরা হার মানব না। আরো দুইদিন ধৈর্য্য ধরে থাক সরলা। তারপর ভেবে দেখবো।’
ঐদিন রাতে রাজা কেউ না দেখে মত রানি মার ঘরে টোকা দিলেন। রানি মা চিৎকার করে উঠলেন, ‘কে? কে?’ রাজা ফিসফিসিয়ে বললেন- আমি গো তোমার প্রাণেশ্বর রাজা প্রতাপ চন্দ্র। তোমার চাঁদপানা মুখটি না দেখে থাকতে পারছি না। এটা শুনে রানি মার মনটা কেঁদে উঠলো। বললেন- আমি ও পারছি না রাজা মশাই। আপনি তাহলে এর ন্যায্য বিচার করুন।
রাজা বললেন- ঠিক আছে কালকেই আবার বিচার হবে।
পরদিন আবার বিচার সভা। নাপিত আর তার বউকে ডেকে আনা হলো। রাজামশাই বললেন- ঐদিন আমার বিচার যথাযথ হয়নি। নাপিত তুমি তোমার বউয়ের গায়ে হাত তুলে অন্যায় করেছো। এই কয়দিনে সবাই নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন, নারী ছাড়া আমরা পুরুষরা কখনোই চলতে পারি না। বউয়ের গায়ে হাত তোলার অপরাধে নাপিতকে একশ ঘা বেত্রাঘাত করা হোক। এটা শুনেই নাপিত বউ কেঁদে বললো, ‘মহারাজ আপনার পায়ে পড়ি। দয়া করে আপনি এটা করবেন না। বেচারা এমনিতে এই কয়দিন না খেতে পেরে হাড্ডিসার হয়ে গেছে। ওকে আপনি ক্ষমা করুন।’ নাপিত বউ এর আকুতি দেখে রাজা ক্ষমা করে দিলেন।কিন্তু বললেন- আজ থেকে যারা এই রাজ্যে নারীদের গায়ে হাত তুলবে তাদের গর্দান যাবে। রাজার ঘোষণা শুনে সবাই রাজার নামে জয়ধ্বনি করতে লাগলো। আর নাপিত বউকে ধন্য ধন্য করতে লাগলো ঐ রাজ্যের নির্যাতিত নারীরা। (সমাপ্ত)
বি:দ্র: ‘নাপিত বউ’ গল্পটি কোনো বিশেষ গোষ্ঠী বা জাতিকে হেয় করার জন্য রচিত নয়। পাঠকদের আনন্দ দানের মাধ্যমে এই রম্য গল্পটি রচনা করে নারী নির্যাতন বন্ধ করার লেখকের সামান্য প্র্রয়াস মাত্র।