ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে গাড়িতে যাত্রীবেশে ছিনতাই

top Banner

::এম মাঈন উদ্দিন::
গত ১৯ ডিসেম্বর বিকেল ৩টায় জোরারগঞ্জ এলাকায় যাওয়ার জন্য অলংকার বাসস্ট্যান্ডে অপেক্ষা করছিলেন মিরসরাই উপজেলার বাসিন্দা দুবাই প্রবাসী হোসেন মাস্টার। ওই সময় একটি মাইক্রোবাস তাকে ১০০ টাকা ভাড়ায় গন্তব্যে পৌঁছে দিবে বলে জানায়। চারজন যাত্রীকে দেখতে পেয়ে হোসেন ওই টাকায় মাইক্রোবাসে উঠে পড়েন। কিছু পথ যাওয়ার পর মাইক্রোবাসে থাকা চার যাত্রী হাতুড়ি এবং স্ক্রু ড্রাইভার দিয়ে তার ওপর হামলা করে। এ সময় তার কাছ থেকে নগদ ১০ হাজার টাকা, দুটি স্বর্ণের আংটি. মোবাইল ফোন ও পাসপোর্ট ছিনিয়ে নেয়। নির্যাতনের পর গুরত্বও আহত হোসেন মাস্টারকে চট্টগ্রাম-ঢাকা মহাসড়কে এলোমেলো ঘুরিয়ে কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম থানার উত্তর বেতিয়ারা নামক স্থানে ফেলে দেয়। পরে উদ্ধার করে স্থানীয় লোকজন ও আত্মীয় স্বজন চট্টগ্রাম মেডিকেল কালজ (চমেক) হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।

জানা গেছে, দেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন ও ব্যস্ত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে বিভিন্ন গাড়িতে যাত্রীবেশে ছিনতাইয়ের ঘটনা বেড়ে চলছে। এতে আতংকের মধ্যে গাড়িতে চলাচল করতে হচ্ছে অনেক যাত্রীকে। বিশেষ করে মাইক্রো, হাইচ, নোহা গাড়িতে এসব ছিনতাইয়ের ঘটনা বেশি ঘটছে।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে মিরসরাই, বারইয়ারহাট-সীতাকুন্ডে যারা প্রতিদিন গাড়িতে যাওয়া আসা করেন তাদের টার্গেট করেন সংঘবদ্ধ ছিনতাইকারী দল। কয়েকটা সংঘবদ্ধ চক্র দেশে ছুটিতে আসা প্রবাসী, ব্যবসায়ী ও ব্যাংকারদের টার্গেট করছে বেশি।

প্রবাসী হোসেন মাস্টার খুন হওয়ার ঘটনায় গত ১২ জানুয়ারি দিবাগত রাতে সিএমপি’র ডিবি, পাহাড়তলী ও আকবরশাহ থানা পুলিশ যৌথ অভিযান চালিয়ে অলংকার মোড় এলাকা থেকে সংঘবদ্ধ ছিনতাইকারী চক্রের ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন, মো. শাহ আলম আকন(৩২), মো. আবুল কালাম (৪৭), মো. জাকির হোসেন প্রকাশ সাঈদ প্রকাশ তৌহিদ (৩৬), মো. আল আমিন (২৯), মো. মিজানুর রহমান প্রাশ টান মিয়া (৫৩), মো. নাহিদুল ইসলাম প্রকাশ হারু (৩১)। অভিযানের এক পর্যায়ে ছিনতাইয়ের পরিকল্পনার সময় প্রথমে ছিনতাইকারী দলের চার সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী বাকি সদস্যদের গ্রেপ্তার করা হয়। এসময় মাইক্রোবাস, হাতুড়ি, স্ক্রু ড্রাইভার, দুইটি টিপ ছোরা, গামছা, ১০টি মোবাইল ফোন, একটি পাসপোর্ট এবং ভিসার কপি জব্দ করে পুলিশ।

মহাসড়কে চলাচলকারী চালকসহ সংশ্লিষ্ট ভুক্তভোগীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, মহাসড়কের বিভিন্ন অংশে ইদানীং যাত্রীবেসে ছিনতাই বেড়েছে। ছিনতাইকারীদের খপ্পরে পড়ে যাত্রীরা সর্বস্ব হারাচ্ছেন, কখনো কখনো আহত হচ্ছেন। পুলিশের সঙ্গে হাইওয়ে পুলিশের সমন্বয়হীনতার কারণে ভুক্তভোগীরা কোনো ধরনের প্রতিকার পাচ্ছেন না। মহাসড়কের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পয়েন্টে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ক্যাম্প না থাকা এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের স্বল্পতার কারণে বেশিরভাগ ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। তবে কয়েকজন ভুক্তভোগী যাত্রী বলেন, ছিনতাই রুখতে পুলিশকে আরো দায়িত্বের সঙ্গে তৎপরতা বাড়াতে হবে।

এদিকে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে দিনে এবং রাতে ছিনতাইকারীর উৎপাত বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। কখনো গাড়িতে যাত্রীবেশে কখনো বা প্রাইভেটকার ও মারুতি মাইক্রোবাসে সংঘবদ্ধ এসব চক্রের কবলে পরে সর্বশান্ত হচ্ছেন অনেকেই। গত কয়েক মাসে এমন বেশ কিছু অভিযোগ শোনা গেলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীরা অভিযোগ বা মামলা করেননি। এতে করে দিন দিন মহাসড়কে বেড়েই চলেছে ছিনতাই সহ অনাকাঙ্খিত ঘটনা।

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, মহাসড়কের ফেনীর লালপোল থেকে সীতাকুন্ডের কুমিরা পর্যন্ত গত বছরে প্রায় শতাধিক গাড়িতে যাত্রীবেসে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে।

জানা গেছে, গেল বছরের গত ১৪ জানুয়ারি বিকেলে ৫টা সময় স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার জন্য বড়তাকিয়া থেকে একটি মাইক্রোবাসে উঠেন এক কলেজ শিক্ষক। মাইক্রোতে যাত্রীবেসে আরো ৬ ছিনতাকারী ছিল। মিরসরাই সদর পার হওয়ার পর অস্ত্রের মুখে সবাইকে জিম্মী করে ফেলে। এরপর তাঁর স্ত্রীর কাছ থেকে ৪ ভরি স্বর্ণালংকার ৩ টা মোবাইল, বারইয়ারহাট ডাচ্ বাংলা বুথ থেকে ১ লাখ টাকা, ইসলামী ব্যাংকের বুথ থেকে ৩০ হাজার টাকা ও নগদ ৪ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কলেজ শিক্ষক জানান, ওইদিন বিকেলে ৫টার দিকে গ্রামের বাড়ি যাওয়ার জন্য একটি সাদা মাইক্রো বাসে উঠি। মিরসরাই থানা পার হওয়ার পর জোরে শব্দ করে গান বাজিয়ে দেয়। এরপর আমি এবং আমার স্ত্রীকে জিম্মী করে সাথে থাকা স্বর্ণালংকার, মোবাইল, নগদ টাকা ছিনিয়ে নেয়। এরপর মাইক্রো টি বারইয়ারহাট থেকে আবার বড়তাকিয়ার দিকে ঘুরিয়ে দেয়। এভাবে ৫ টা থেকে সাড়ে ৭ টা পর্যন্ত ৪ বার বড়তাকিয়া-বারইয়ারহাট আসা যাওয়া করে। এই আড়াই ঘন্টা সময়ে আমার উপর কি পরিমাণ শারীরিক নির্যাতন করেছে ভাষায় প্রকাশ করতে পারবোনা। হাতুড়ি দিয়ে আমার শরীরে আঘাত করেছে। অমানুষিক নির্যাতন করেছে। একজন মাফলার দিয়ে পেছন থেকে গলা পেছিয়ে ধরে আমার সাথে থাকা এটিএম কার্ড নিয়ে ডাচ্ বাংলা বুথ বারইয়ারহাট থেকে ১ লাখ টাকা, ইসলামী ব্যাংকের বুথ থেকে ৩ হাজার টাকা উত্তোলন করে। পরে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে বড়তাকিয়ার উত্তর পাশে ব্রাক অফিসের সামনে চোখে মলম লাগিয়ে আমাদের নামিয়ে দেয়। এরপর একটি সিএনজি যোগে আমরা হাসপাতালে যাই। এঘটনায় মিরসরাই থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করেছি। আমি এখনো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছি। এখনো আমার দুই সন্তান ঘুমের মধ্যে ভয় পেয়ে উঠে। আমারও অপরিচিত মানুষ দখলে ভয় লাগে।

একই বছরের ৮ জানুয়ারি রাত ৮টা সময় বারইয়ারহাট থেকে চট্টগ্রাম যাওয়ার জন্য মাইক্রোবাসে উঠা ইসলামী ব্যাংক বারইয়ারহাট শাখার কর্মকর্তা আব্দুল মোমিন, এজেন্ট ব্যাংকিং কর্মকর্তা মিজানুর রহমান ও অজ্ঞাত এক ব্যক্তির কাছ থেকে অস্ত্রের মুখে সব ছিনিয়ে নেয় মাইক্রোতে যাত্রীবেসে থাকা ছিনতাইকারীরা। সাথে থাকা মোবাইল, মানিব্যাগ, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র, এটিএম কার্ড ছিনিয়ে নেয়। অস্ত্রের মুখে জিম্মী করে আব্দুল মোমিনের এটিএম কার্ড দিয়ে মিরসরাই সদরে অবস্থিত শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের বুথ থেকে ৪০ হাজার টাকা উত্তোলন করে। এরপর উপজেলার ছরারকুল এলাকায় অজ্ঞান করে মাইক্রো থেকে তাদের ফেলে দিয়ে চলে যায়। পরে স্থানীয় লোকজন তাদের উদ্ধার করে চমেক হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করান।

পুলিশ জানায়, বরিশাল এলাকা থেকে ছিনতাইকারী দলের সদস্যরা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যাত্রী ও চালক সেজে প্রবাসীদের টার্গেট করে মাইক্রোবাসে তুলে দেয়। এরপর এক পর্যায়ে হাতুড়ি, স্ক্রু ড্রাইভার, টিপ ছুরি দিয়ে নির্মমভাবে আঘাত করে নগদ টাকা, মূল্যবান জিনিসপত্রসহ পাসপোর্ট ছিনিয়ে নেয়। ছিনতাই শেষে নির্জন স্থানে ভুক্তভোগীদের ফেলে দেয় তারা।

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যাতায়াত নিয়মিত যাত্রী মুহাম্মদ নিজাম উদ্দিন বলেন, আমরা যারা নিয়মিত প্রতিদিন যাতায়াত করি আমরা কোন অবস্থাতেই যেন কোন অপরিচিত প্রাইভেট কার এবং মাইক্রোতে না উঠি। প্রায় প্রতিদিন সন্ধ্যায় এমন কালো প্লাসের মাইক্রোগুলো যাওয়ার জন্য ডাকে। এরা কিন্তু দীর্ঘদিন যাবৎ আপনার গতিবিধি লক্ষ্য করে, নজর রাখে। তারপর টার্গেট করে, কোনভাবে মাইক্রোতে উঠাতে পারলেই ছিনতাই করে। তাই, যতই তাড়া থাক না কেন, এসব গাড়িতে উঠবেন না।

এই বিষয়ে জোরারগঞ্জ হাইওয়ে পুলিশের ইনচার্জ এ.কে.এম শরফুদ্দীন বলেন, ইদানিং ছিনতাইয়ের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় বারইয়ারহাট কেন্দ্রীক সন্ধ্যার পর আমাদের কয়েকটি টিম কাজ করছে। আমাদের জনবল সংকট রয়েছে। তারপরও আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। তিনি আরো বলেন, চালক, পথচারী ও যাত্রীদের সচেতনতায় লিফলেট বিতরণসহ নানা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে হাইওয়ে পুলিশ। অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতি এড়াতে সচেতনতার বিকল্প নেই। অপরিচিত প্রাইভেট কার বা গাড়িতে না ওঠাই উত্তম।

আরো খবর