মিরসরাইয়ে চাঞ্চল্যকর একাধিক হত্যা মামলায় জনপ্রতিনিধিদের জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। এসব হত্যাকান্ডের ঘটনায় প্রধান আসামি করে তাদের নামে মামলাও দায়ের করা হয়েছে। এসব মামলা বর্তমানে চট্টগ্রাম আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। হত্যাকান্ডের মতো জগন্য ঘটনায় জনপ্রতিনিধিরা জড়িত থাকায় সাধারণ মানুষের মাঝে বিরূপ প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেছে।
যুবলীগ কর্মী হত্যাকান্ড: খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ১৯ সেপ্টেম্বর যুবলীগকর্মী শহিদুল ইসলাম আকাশকে হত্যার অভিযোগে স্থানীয় হিঙ্গুলী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ২ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য মিজানুর রহমানকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। মঙ্গলবার (২০ সেপ্টেম্বর) দিবাগত রাতে অভিযান চালিয়ে চিনকিরহাট এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ওই মামলায় নিহত আকাশের বোন নাজমা আক্তার বাদি হয়ে ১৪ জনের নামে একটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় ইউপি সদস্য মিজানুরকে ৫ নম্বর আসামী করা হয়।
ছাত্রলীগ নেতা রাজু হত্যা কান্ড : গত ৯ জুলাই ঈদুল আযাহার আগের রাতে জোরারগঞ্জ ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ন সম্পাদক ইব্রাহিম রাজুকে কুপিয়ে মারাত্মক জখম করে পায়ের রগ কেটে দেওয়া হয়। তাকে উদ্ধার করে প্রথমে স্থানীয় মিরসরাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে অবস্থার অবণতি হওয়ায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে প্রেরণ করা হয়। চমেক হাসপাতালে আসার পথেই তার মৃত্যু হয়। এই ঘটনায়ও জোরারগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষেদের ৭ নং ওয়ার্ডের সদস্য শাহিনুর হোসেন শাহিন এর নাম আলোচনায় আসে।
নিহত ইব্রাহিম রাজুর বাবা মহিউদ্দিন গত ১১ জুলাই ইউপি সদস্য শাহিনুর হোসেন শাহিনকে প্রধান আসামী এবং আরো ১৬ জনের নাম উল্লেখ করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। গত ৬ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম নগরীর অলংকার মোড় এলাকা থেকে প্রধান আসামী শাহিনকে গ্রেফতার করে র্যাব-০৭। বর্তমানে তিনি কারাগারে রয়েছেন।
৬ বারের ইউপি সদস্য কাশেম মেম্বার হত্যাকান্ড : চলতি বছরের ২৬ জানুয়ারী মিরসরাইয়ের সাহেরখালী ইউনিয়ন পরিষদের ৬ বারের সাবেক ইউপি সদস্য আবুল কাশেম মেম্বারকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুরুতর জখম করা হয়। মুমূর্ষ অবস্থায় প্রথমে স্থানীয় একটি হাসপাতালে এবং পরবর্তীতে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। দীর্ঘ ৬ দিন মৃত্যুর সাথে লড়াই করে ১ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাতে না ফেরার দেশে চল যান তিনি।
কাশেম মেম্বার আহত হওয়ার পর থেকে ঘটনার সাথে জাড়িত থাকার বিষয়ে মিরসরাইয়ের তালিকাভূক্ত ২ নং ডাকাত বেলাল হোসেন এর নাম উঠে আসে।
এই ঘটনায় নিহতের স্ত্রী বিবি ফাতেমা সাহেরখালী ইউনিয়নের ০৩ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য বেলাল হোসেনকে প্রধান আসামী এবং আরো ৭ জনের নাম উল্লেখ করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। এই মামলায় প্রধান আসামী বেলাল হোসেনকে রাজধানীর কাজলা এলাকা থেকে ১০ ফেব্রুয়ারি গ্রেফতার করে র্যাব-০৭। গত ১০ মার্চ তিনি আদালত থেকে জামিন লাভ করেন। জামিন পেয়ে মামলার বাদী নিহত আবুল কাশেম মেম্বারের স্ত্রী ও ছেলে-মেয়েকে হুমকি-ধমকি প্রদান করেন। গত ২৪ এপ্রিল হুমকির অভিযোগ এনে ফাতেমা বেগম মিরসরাই থানায় একটি সাধারণ ডায়েরী (জিডি) করেন। পুলিশ ঘটনার তদন্ত করে সত্যতা পায় এবং আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করেন। পুলিশের প্রতিবেদনের উপর ভিত্তি করে গত ২৭ জুন বেলাল হোসেনকে পুনরায় কারাগারে প্রেরণ করেন। এখনো সে কারাগারে রয়েছেন।
ফার্ণিচার দোকানের কর্মী খুন: গত বছরের ২৫ জুন মিরসরাই পৌর সদরের হোপ মা ও শিশু হাসপাতাল ভবনের ৫ম তলায় নিয়ে মো: আজিম হোসেন শাহাদাত (২০) নামের এক যুবককে পিটিয়ে গুরুতর আহত করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে মোবাইল চুরির অভিযোগ এনে রাতভর নির্যাতন করে পরদিন সকালে মুমূর্ষ অবস্থায় জোর করে গাড়িতে তুলে দিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। পথেই যুবকের মৃত্যু হয়। নিহত শাহাদাত মিরসরাইয়ের একটি ফার্ণিচারের দোকানে কাজ করতেন। তার বাড়ি ফেনীর জেলার দাগনভূঁঞা এলাকার হাছান গণিপুর গ্রামে।
এই ঘটনার পরদিন নিহত আজিম হোসেনের বাবা আব্দুল বাতেন মিরসরাই পৌরসভার ৪ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র শাখের ইসলাম রাজু এবং আরো তিনজনকে আসামি করে মিরসরাই থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। এরপর ২৮ জুন ভোর রাতে চট্টগ্রাম শহরের একটি বাসা থেকে অভিযান চালিয়ে কাউন্সিলরকে গ্রেফতার করে মিরসরাই থানা পুলিশ। এই মামলার তদন্ত শেষে কাউন্সিলরকে প্রধান আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। দুই দফায় কারাভোগ করে বর্তমানে কাউন্সিলর জামিনে রয়েছেন।
সাবেক ইউপি সদস্য আবুল কাশেম মেম্বারের স্ত্রী বিবি ফাতেমা বলেন, রক্ষক যখন ভক্ষক হবে তবে মানুষ কোথায় যাবে। আমার স্বামীও জনপ্রতিনিধি ছিলেন। জনগনের ভোটে ছয়বার মেম্বার নির্বাচিত হয়েছেন। নিজের পকেটের টাকা খরচ করে মানুষের সেবা করেছেন। আর আমার স্বামীকে প্রাণ দিতে হয়েছে একজন ডাকাতের হাতে। সমাজের শিক্ষিত মানুষগুলোর বিবেক যখন পঁচে যায় তখন বেলালের মতো সন্ত্রাসী, ডাকাতেরা জনপ্রতিনিধি হয়।
ছাত্রলীগ নেতা ইব্রাহিম রাজুর পিতা মহিউদ্দিন বলেন, একজন মেম্বার মানুষের সেবা না করে মানুষ হত্যা করে তাহলে মানুষ যাবে কোথায়। জনপ্রতিনিধিদের জনসেবক না বানিয়ে যারা দানব বানাচ্ছে তাদেরও বিচার হওয়া উচিৎ।
সুজন (সুশাসনের জন্য নাগরিক) মিরসরাই উপজেলার সাধারণ সম্পাদক শাহাদাত হোসেন বলেন, জনগনের রক্ষকরাই এখন ভক্ষক। ক্ষমতার দাম্ভিকতা, অংহকার ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে জনপ্রতিনিধিরা হত্যাকান্ডের মতো ঘটনার সাথে জড়াচ্ছে। এখন সুশাসনের খুব অভাব। জনপ্রতিনিধিরা যা খুশী তা করে যাচ্ছে।
মিরসরাই সার্কেল এর সহকারি পুলিশ সুপার লাবিব আব্দুল্লাহ বলেন, কারো বিরুদ্ধে যখন মামলা হয়, তখন সে কি জনপ্রতিনিধি, সমাজসেবক, দানবীর আমাদের দেখার বিষয় না। আইন আইনের গতিতে চলবে। আমরা মামলার তদন্ত করে আদালতে রিপোর্ট দাখিল করে থাকি। যে তিনিটি হত্যা মামলায় জনপ্রতিনিধিরা আসামী হয়েছে তার মধ্যে ২টি মামলা তদন্ত রিপোর্ট আদালতে প্রেরণ করা হয়েছে। মিরসরাই ও জোরারগঞ্জ থানার দুই ওসি এই তিনটি মামলা নিয়ে যথেষ্ট কাজ করেছেন এবং এখনো করছেন। বিশেষ করে সাহেরখালী ইউনিয়ন পরিষদেরে সাবেক মেম্বার আবুল কাশেম হত্যা মামলায় অনেক অগ্রগতি হয়েছে।