আজমল হোসেন: কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে সরগরম হয়ে উঠেছে মিরসরাই উপজেলার হাট-বাজারের কামার পল্লীগুলো। কামার দোকানের সামনে দিয়ে হেঁটে যেতে কানে আসে স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি টুংটাং শব্দ। কর্মব্যস্ততাও বেড়েছে কর্মকারদের। ঈদকে ঘিরে তৈরি হচ্ছে ছুরি, দা, বটি ও চাপাতি। কামাররা হাফরের স্ফুলিঙ্গ থেকে বের করা রক্তরঙা লোহায় হাতুড়ির আঘাতে আনছেন সরঞ্জামের আকৃতি।
তৈরিকৃত এসব সরঞ্জাম নিয়ে কর্মকাররা হাটবারে সাজান তাদের পসরা। ত্রেতারা দেখেশুনে বাছাই করে কেনেন তাদের প্রয়োজনীয় কোরবানীর সরঞ্জাম। হাটবারে কর্মকারদের এসব অস্থায়ী পসরায় লক্ষ করা গেছে অতিরিক্ত ভীড়। এসব পসরার বাইরেও কারখানার সামনে বেচাবিক্রি চলে। নতুন সরঞ্জামের পাশাপাশি কেউবা পুরাতন সরঞ্জামের মেরামত করতে নিয়ে আসেন এসব কারখানায়। কামাররাও অধিক মূল্য হাঁকছেন এগুলো মেরামত করতে। অনেকে আবার সান দেয়ার যন্ত্র নিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরছেন কোরবানী করার যন্ত্রপাতি ধারালো করতে।
সরেজমিনে উপজেলার আবুতোরাব ও মিঠাছড়া বাজারে গিয়ে দেখা যায়, পুরাতন দা বটি ছুরি ইত্যাদি সরঞ্জাম সংস্কার করাতে কামারশালায় ভিড় জমাচ্ছেন লোকজন। কমারশালায় কেউ সেসব কাজ বুঝে নিচ্ছেন, কেউবা কাজ শেষ হওয়া সরঞ্জাম বুঝিয়ে দিচ্ছেন। কেউ অনর্গল হাফর টানছেন, কেউবা পোড়া লোহায় হাতুড়ি পেটাচ্ছেন। মালিক কর্মচারী কারোরই নেই দম ফেলার ফুসরত।
ক্রেতাদের অভিযোগ, করোনা মহামারীর অজুহাতে এ বছরও সরঞ্জামের দাম অনেক বেশি রাখা হচ্ছে। অপরদিকে কামারদের বক্তব্য, ইস্পাত ও কয়লার দাম বেড়ে যাওয়ায় এ বিড়ম্বনার সৃষ্টি হয়েছে।। বেশি দামে লোহা কেনাতে বিক্রিও করতে হচ্ছে সামান্য বাড়তি দামে। প্রতি সরঞ্জামে আগের চেয়ে দাম ২০-৫০ টাকা বেশি।
আবুতোরাব বাজারের কামার পল্লীর ব্যবসায়ী রনজিত কর্মকার বলেন, এখনো আমরা পুরাতন কাজ করছি। এ বছর নতুন সরঞ্জাম বিক্রি এখনো শুরু হয়নি। তবে আমরা দিনরাত পরিশ্রম করে নতুন সরঞ্জাম তৈরি করছি। আশা করছি দুএকদিনের ভেতর সেসব সরঞ্জাম বিক্রি শুরু হবে।
আরেক ব্যবসায়ী টোটন কর্মকার বলেন, এ বছর কাজ আগের বছরের তুলনায় বেশি। নতুন বিক্রি শুরু না হলেও আশানুরুপ পুরাতন সরঞ্জামের সংস্কার কাজ পাচ্ছি।
কর্মকাররা জানান, বছরের ১১ মাস তাদের ব্যবসা হয় কোন রকমে পেট চলার মতো। আর কোরবানির ঈদে ব্যবসা হয় বছর জুড়ে চলার মতো সঞ্চয়। কর্মকারদের সাথে আলাপ করে জানা যায়, এসব সরঞ্জাম তৈরিতে সাধারণত কাঁচা ও পাকা লোহা ব্যবহার করা হয়। পাকা লোহার মধ্যে স্প্রিং লোহা দিয়ে তৈরি সরঞ্জামের মান ভালো, দামও বেশি। আর কাঁচা লোহার তৈরি উপকরণগুলোর দাম তুলনামূলকভাবে কম। কাঁচা হিসাবে এ্যাঙ্গেল, রড, স্টিং, মোটরগাড়ির পাত ইত্যাদি ব্যবহার হয়। লোহার মানভেদে একটি দা পাঁচ থেকে সাত শ’ টাকা (পাকা লোহা), আর কাঁচা লোহার দা চার থেকে পাঁচ শ’ টাকা। পশুর চামড়া ছাড়ানোর ছুরি এক থেকে সাড়ে তিন শ’, পশু জবাইয়ের বিশেষ ছুরি দেড় থেকে তিন হাজার, কুড়াল ছয় শ’ থেকে এক হাজার, বঁটি তিন থেকে আট শ’, চাপাতি পাঁচ শ’ থেকে দেড় হাজার টাকায় বিক্রি হয়। এদিকে দেশীয় এসব উপকরণের পাশাপাশি চায়না থেকে আমদানি করা বিভিন্ন মান ও আকারের উপকরণও বাজারে বিক্রি হচ্ছে।
মিঠাছড়া বাজারের কামার পল্লীর ব্যবসায়ী সুজয় কর্মকার বলেন, এটি আমাদের পৈত্রিক পেশা। সারাদিন আগুনের তাপ ও লোহা পেটানোর মতো পরিশ্রম করে তৈরি করা এসব সরঞ্জাম। কর্মচারীর বেতন, দোকানের খরচ মিটিয়ে এসব বিক্রি করে খুব বেশি লাভ টেকে না। তবে পরিবার-পরিজন নিয়ে ডাল-ভাত খেয়ে জীবন চলে। সারা বছর কাজ খুবই কম থাকে কোরবানি ঈদকে সামনে রেখে আমাদের কাজ বাড়ে।