চলমান রিপোর্ট
ব্যাপক অনিয়ম, কারচুপির মধ্য দিয়ে চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার ১৬ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ভোট গ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। বৃহস্পতিবার (১১ নভেম্বর) সকাল ৮টা থেকে একটানা বিকেল ৪ টা পর্যন্ত ভোট গ্রহণ করা হয়। জালভোট ও কারচুপির অভিযোগে নির্বাচন বর্জন করেছেন ১২ নং খৈয়াছরা ইউনিয়নে বিদ্রোহী চেয়ারম্যান প্রার্থী (ঘোড়া প্রতীক) জাহেদ ইকবাল চৌধুরী।
উপজেলার ১৩ টি ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী এবং ৬ জন সংরক্ষিত ও ১৩ জন সাধারণ সদস্য আগেই একক প্রার্থী হিসেবে বিজয়ী হয়েছেন। শুধুমাত্র ইছাখালী, খৈয়াছরা ও মিরসরাই ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে এবং সবগুলো ইউনিয়নে সদস্য ও সংরক্ষিত সদস্য পদে বৃহস্পতিবার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে।
এখানকার ইউনিয়নগুলোতে চেয়ারম্যান পদে ৯ জন, সাধারণ সদস্য পদে ৪৮৯ জন ও সংরক্ষিত সদস্য পদে ১১৮ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্ধিতা করেছেন। অস্থায়ী ৯টি কেন্দ্র সহ মোট ১৪৮টি কেন্দ্রে ভোটগ্রহন হয়। ৯নং মিরসরাই সদর ইউনিয়নে ইভিএমে ও বাকী ১৫টি ইউনিয়নে ব্যালটের মাধ্যমে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছে। নির্বাচনে ১৪৮ জন প্রিসাইডিং কর্মকর্তা, ৯’শ জন সহকারি প্রিসাইডিং কর্মকর্তা, ১ হাজার ৮’শ জন পোলিং অফিসার দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া ১ জন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ৫ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, ৩ প্লাটুন বিজিবি, প্রতিকেন্দ্রে ৫-৭ জন পুলিশ, ১৮-২০ জন আনসার সদস্য নির্বাচনী কেন্দ্রে নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন।
খৈয়াছড়া ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে বিদ্রোহী প্রার্থী জাহেদ ইকবাল চৌধুরী প্রহসনের নির্বাচন আখ্যা দিয়ে নির্বাচন বর্জন করেছেন। এছাড়া তিনি নির্বাচন স্থগিতেরও দাবি জানিয়েছেন।
বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১১টার দিকে বিদ্রোহী প্রার্থী জাহেদ ইকবাল চৌধুরী এ নির্বাচনকে একতরফা প্রহসন মূলক নির্বাচনের সাথে তুলনা করে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান। এসময় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আমি অনেক হামলা বাধা বিপত্তির মধ্যেও নির্বাচনে অংশ নিয়েছি। প্রত্যাশা ছিলো শেষ পর্যন্ত থাকার। ভোটের আগের দিন থেকে আমাকে এবং আমার পরিবারকে আমার বাংলো বাড়িতে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। আমার বাড়ির ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়। সকালে ভোট কেন্দ্রে যেতে চাইলে একাধিকবার আমি এবং আমার পরিবারের ওপর হামলা করা হয়। তাও অনেক কষ্টে কেন্দ্রে গিয়ে দেখতে পেলাম দুইটি বুথে সবগুলো ব্যালট পেপারে আগে থেকে সিল মেরে রাখা হয়েছে। আমি এটি নিয়ে উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হবো।
এদিকে বৃহস্পতিবার বিকাল আড়াইটার দিকে নির্বাচন স্থগিতের দাবি জানিয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তা ডা. শ্যামল চন্দ্র পোদ্দারের কাছে একটি লিখিত অভিযোগ দিতে গেলে তিনি তা গ্রহণ করেন নি বলে অভিযোগ করেন প্রার্থী নিজে।
এ বিষয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তা শ্যামল চন্দ্র পোদ্দার বলেন, আমি নির্বাচন স্থগিত করতে পারিনা। তাই আমি এটি গ্রহণ করিনি।
একই ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী মাহফুজুল হক জুনু বলেন, নির্বাচনে কোন ধরনের কারচুপি নেই। জনগণ স্বতঃপূর্ত ভাবে ভোট দিয়েছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, জনগন আমাকে ভোট দিয়ে বিপুল ভোটে নির্বাচিত করবে।
সরেজমিনে সকাল ১০টায় খৈয়াছড়া ইউনিয়নের ১ নং ওয়ার্ডে দেখা যায় ভোটারবিহীন শুন্য ভোটকেন্দ্র। কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার বশির আহম্মদ সরদার জানান, এ কেন্দ্রে ৩৬০০ ভোটের মধ্যে সকাল ১০ টা পর্যন্ত ৪০০ ভোট কাস্ট হয়েছে। একই কেন্দ্রে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে পুরুষদের একটি বুথে ঢুকে চেয়ারম্যান প্রার্থীর ব্যালট বইয়ে আগে থেকে নৌকা প্রতীকে সিল মারা দেখা গেছে। এছাড়া মেম্বার পদে মোরগ প্রতীকেও সিল মারা দেখা গেছে।
সকাল সাড়ে ১০টায় খৈয়াছড়া ইউনিয়নের ৮ নং ওয়ার্ডের ভোটকেন্দ্রে কিছুটা বিশৃঙ্খলা দেখা গেলেও ভোটারদের উপস্থিতি ছিলো ভালো। এ কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার নাজিমুজ্জামান জানান, এ কেন্দ্রের ২১৩৪ জন ভোটারের মধ্যে সকাল সাড়ে ১০টা পর্যন্ত ৮০১ টি ভোট কাস্ট হয়েছে।
১২ নং খৈয়াছড়া ইউনিয়নের ৮ নং ওয়ার্ডে ফুটবল প্রতিকের মেম্বার প্রার্থী আবু বক্কর সিদ্দিক অভিযোগ করেন তার প্রতিদ্বদ্ধি প্রার্থী নুরুল আমিনের লোকজন জোরপূর্ব ব্যালট ছিনিয়ে নিয়ে তালা প্রতিকে ভোট দিচ্ছেন।
১০নং মিঠানালা ইউনিয়নের ৭ নং ওয়ার্ডের মেম্বার পদপ্রার্থী আজিম উদ্দিন অভিযোগ করেন তার প্রতিদ্ধন্দি প্রার্থি আব্দুল মজিদ তার ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে যেতে বাঁধা দেন।
১১ নং মঘাদিয়া ইউনিয়নের ৫ নং ওয়ার্ডের মোরগ প্রতীকের মেম্বার পদপ্রার্থী রবিউল হোসের রণি অভিযোগ করেন তার প্রতিদ্বন্দি প্রার্থীর লোকজন তার ভোটারদের কেন্দ্রে আসতে বাঁধা দিচ্ছে। এছাড়াও তার কর্মীদের মারধরের অভিযোগ করেন তিনি।
দুর্গাপুর ইউনিয়নের সংরক্ষিত ৪, ৫, ৬ নং ওয়ার্ডের প্রার্থী আলেয়া বেগম অভিযোগ করেন, ৩টি ভোট কেন্দ্রে ভোটারদের ঢুকতে দেয়া হয়নি।
এদিকে ইছাখালী ইউনিয়নের সবকটি কেন্দ্রে ঘুরে দেখা গেছে, কোথাও স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী মোহাম্মদ মোস্তফার আনাসর প্রতীকের এজেন্টদের ভোটকেন্দ্রে ঢুকতে দেয়া হয়নি।
চেয়ারম্যান প্রার্থী মোঃ মোস্তফা অভিযোগ, ইছাখালী ইউনিয়নের ৯টি ওয়ার্ডের কোন ভোট কেন্দ্রে নৌকা প্রার্থীর ক্যাডারদের বাঁধায় আমরা এজেন্ট দেয়া যায়নি। আমার বাড়ির চারপাশে সন্ত্রাসীরা অবস্থান নেয়। আমি এই প্রহসনের নির্বাচন মানিনা।
করেরহাট ইউনিয়নের নং ওয়ার্ড অলিনগর ও ৪ নং ওয়ার্ড ছত্তরুয়া এলাকায় মেম্বার প্রার্থীদের কর্মী সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে মেম্বার প্রার্থী জহুরুল হক কোম্পানী সহ কয়েকজন আহত হয়েছে। হিঙ্গুলী ইউনিয়নের বিভিন্ন ওয়ার্ডে মেম্বার প্রার্থীদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা হয়েছে। সাহেরখালী ইউনিয়নের কয়েকটি কেন্দ্রে কারচুপির ঘটনা ঘটেছে।
৩ নং জোরারগঞ্জ ইউনিয়নের ৬ নং ওয়ার্ড ইমামপুর রহিমেন্নেছা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে বেলা ১ টায় গিয়ে দেখা যায় ভোটারবিহীন কেন্দ্র।
প্রিজাইডিং অফিসার ফারুক মোহাম্মদ হায়দার বলেন, এখনো পর্যন্ত মোট ভোটার ২৪৭৮ জনের মধ্যে ১০০০ ভোট কাস্ট হয়েছে। এসময় তিনি বিভিন্ন প্রার্থীর এজেন্টদের ১১ টি মোবাইল জব্দ করেন।
৭ নং কাটাছড়া ইউনিয়নের ৯ নং ওয়ার্ডের মেম্বার প্রার্থী মাঈন উদ্দিনের ভোটারদের চেয়ারম্যান হুমায়ূন ও তার ভাই শামীমের লোকজন ভোটকেন্দ্রে আসতে বাধা দেয়ায় ও ভোট কারচুপির অভিযোগ এনে তিনি ভোট বর্জনের ঘোষনা দেন।
এছাড়া ১৫ নং ওয়হেদপুর ইউনিয়নের ৬ নং ওয়ার্ডের মেম্বার পদপ্রার্থী দিদারুল আলমের ভোটারদের তার প্রতিদ্বন্ধি প্রার্থীর লোকজন ভোটকেন্দ্রে আসতে বাঁধা দেয়ায় তিনিও ভোট বর্জনের ঘোষনা দেন।
৬ নং ইছাখালি ইউনিয়নের ৪ নং ওয়ার্ডের মাদবারহাট ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসা কেন্দ্রে দুপুর আড়াইটার দিকে গিয়ে দেখা যায়, জাল ভোট দেয়াকে কেন্দ্র করে দুই মেম্বার প্রার্থীর কর্মীদের মধ্যে চলছে দাওয়া-পাল্টা ধাওয়া।
এ কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার শামসুল হক বলেন, মোট ভোটার ৩২৬৪ ভোট এর মধ্যে দুপুর ২ টা পর্যন্ত কাস্ট হয়েছে ১২০০ ভোট।
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা ফারুক হোসাইন বলেন, বড় ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই শান্তিপূর্নভাবে উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট গ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা কোন ধরনের বিশৃখলা এড়াতে তৎপর ছিলেন। ১৬ ইউনিয়নের ১৪৪ ওয়ার্ডের ভোটের ফলাফল আসতে রাত ১১ টা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।