মিরসরাই: সম্ভাবনা ও সংকট উত্তরণে করনীয়

top Banner


লায়ন এমডি. এম. মহিউদ্দিন চৌধুরী সিআইপি

ভৌগোলিক দিক থেকে আশীর্বাদপুষ্ট মিরসরাইতে নেই এমন কিছুর সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য। পূর্বাংশে অসংখ্য ঝর্ণার ঝুমঝুম ধ্বনির শিহরণ নিয়ে সুদৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়, পশ্চিমাংশে বিশাল বঙ্গোপসাগরের গর্জন এবং মধ্যভাগে সকল ধর্ম বর্ণের মানুষের মেলবন্ধনে এখানকার সাধারণ জীবনযাপন। প্রকৃতির এক আশ্চর্য্য প্রভাব রয়েছে মিরসরাইয়ের মানুষদের উপর। দেশ ও জাতির যেকোন প্রয়োজনে নিজেদের উজাড় করে দিয়েছে এই জনপদের লোক, তা বিচক্ষণ দৃষ্টি সম্পন্ন মানুষ ইতিহাসের দিকে তাকালেই বুঝতে সক্ষম হবেন। ইতিহাস, ঐতিহ্য ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দিক থেকে মিরসরাই অত্যন্ত সমৃদ্ধ একটি উপজেলা।

মহামায়া লেক, খৈয়াছড়া র্ঝণা, বোয়ালিয়া র্ঝণা, সাগর পাড়, মুহুরি প্রজেক্ট, রুপসী র্ঝণা সহ অসংখ্য প্রাকৃতিক সুন্দর স্থান মিরসরাইকে লোভনীয় করে তুলেছে বিশ^বাসীর কাছে। বর্তমানে মিরসরাই আন্তর্জাতিক আকর্ষণে পরিণত হয়েছে দেশের সর্ববৃহৎ অর্থনৈতিক অঞ্চলের প্রেক্ষাপটে, অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি পরিবর্তনে মিরসরাই হতে যাচ্ছে ট্রাম্প কার্ড। ইতোমধ্যে দেশি-বিদেশী প্রচুর বিনিয়োগের চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে, ক্রমান্বয়ে কর্মসংস্থান হবে ২১ লক্ষেরও অধিক মানুষের। এমন পরিপ্রেক্ষিতে মিরসরাই একটি জনবহুল নগরে উন্নিত হতে যাচ্ছে এবং অবকাঠামোগত বিশাল পরিবর্তন সাধিত হবে। মিরসরাইয়ের যেমন রয়েছে সম্ভাবনা, তেমনি কিছু সংকটের আশঙ্কাও থেকে যায়।

দেশের সর্ববৃহৎ অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মিত হচ্ছে মিরসরাইতে। প্রায় ৩০,০০০ একর জমিতে সরকার নানারকম সুযোগ-সুবিধা দিয়ে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের দৃষ্টি আকর্ষণে সমর্থ হয়েছে। সরকার এখানে বিদ্যুৎ, গ্যাস সহ যাবতীয় অবকাঠামো ছাড়াও নির্মাণ করবে স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল, আবাসিক এলাকা, যুক্ত করবে সমুদ্র বন্দর ও রেল লাইন। ইতিমধ্যে বহু দেশি ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান প্লট বরাদ্দ নিয়েছে। ‘বেজা ‘(Bangladesh Economic Zone Authority) আশা করছে এখানে প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ হবে। বিনিয়োগকৃত প্রতিষ্ঠান গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বেপজা, বিজিএমইএ, এশিয়ান পেইন্টস, জাপানের নিপ্পন স্টিল ও মিতসুবিশি মোটরস, চীনের কুনমিং ও জিনউয়ান, ভারতের আদানী গ্রæপ, বসুন্ধরা গ্রæপ, অনন্ত গ্রæপ, বিএসআরএম, পিএইচপি গ্রæপ, এনার্জি প্যাক, মডার্ণ সিনটেক্স সহ এরকম বহু প্রতিষ্ঠান। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো বেজা আশা করছে আগামি ১৫ বছরে র্কমসংস্থান হবে প্রায় ১.৫ মিলিয়ন লোকের। নগর উন্নয়ন অধিদপ্তরের তথ্যমতে আগামী ২০ বছরে প্রায় ৩০ লক্ষ লোকের বসবাস হবে এই অঞ্চলে। মিরসরাইবাসী আশা রাখতে পারে, আমাদের যুবশক্তির পরিপূর্ণ কাজের সুযোগ পাবে সেখানে এবং এর মাধ্যমে স্থানীয় বেকারত্বের সংখ্যা শূন্যে নেমে আসবে। দেশের অর্থনীতিতে বিশাল অবদান রাখবে মিরসরাইয়ের মাটি, এটি অত্যন্ত আনন্দের বিষয় আমাদের মিরসরাইবাসীর জন্য।

মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলের মাধ্যমে সমগ্র দেশ উপকৃত হলেও স্বাভাবিকভাবে কিছু অসুবিধায় মিরসরাইবাসীকে পড়তে হবে। সমস্যাগুলোর ব্যাপারে এখন থেকে সতর্ক না হলে একসময় এগুলো অনিয়ন্ত্রিত ও ভয়াবহ আকার লাভ করতে পারে। বর্তমানে মিরসরাই উপজেলার সড়ক যোগাযোগ-সহ যাবতীয় অবকাঠামো ও সুযোগ-সুবিধা মাত্র ৬ লক্ষ মানুষের জন্য প্রস্তুত করা। বর্তমানের জন্য তাও পর্যাপ্ত নয়।তাহলে ভবিষ্যৎ এর সমীকরণে সেটি বড় একটি চিন্তার বিষয়। নতুন আগমন করা মানুষদের জন্য প্রয়োজন হবে আবাসন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, রাস্তাঘাট সহ মৌলিক প্রয়োজনীয় উপাদান গুলো। কিন্তু এখনো আমরা অন্ধকারে আছি এসব মৌলিক প্রয়োজনীয়তা নিশ্চিত করবে কে বা কিভাবে? একদিকে বর্ষাকালে আমাদের নিত্য জলাবদ্ধতা তখন বেড়ে তীব্র আঁকার লাভ করতে পারে, অন্যদিকে গ্রীষ্মকালে দেখা যেতে পারে পানীয় জলের তীব্র সংকট। ভূগর্ভস্থ সুপেয় পানীর সংকট ইতিমধ্যে কয়েকটা ইউনিয়নে দেখা দিয়েছে। এখন এমন পরিস্থিতি হলে, অর্থনৈতিক অঞ্চলের বাস্তবতায়কি হতে পারে! সমুদ্র উপকূলে গত চার দশক ধরে গড়ে উঠা কেওড়া বন এখন যৎসামান্য টিকে আছে, বাকিটাও কিছুদিনের মধ্যে উজাড় হয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে পরিবেশের যে মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে তা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। অতিরিক্ত জনসংখ্যার কারণে বাড়বে মাদক, হত্যা, খুন সহ নানা সামাজিক অপরাধ। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মারাত্মক ক্ষতি সাধন হতে পারে। ইতিমধ্যে মানুষ যততত্র বাড়িঘর নির্মাণ করছে অপরিকল্পিতভাবে। বর্তমানে ৬ লক্ষ মানুষের মিরসরাইয়ে যদি বহু জিনিসের অপ্রাপ্তির খাতায় নাম থাকে, আগামীতে ৩০ লক্ষ মানুষের জন্য কতটুকু প্রস্তুতি আছে আমাদের?
ভৌগোলিক দিক হতে মিরসরাই বাংলাদেশ ও চট্টগ্রামের একমাত্র গেটওয়ে। চট্টগ্রাম বাণিজ্যিক রাজধানী হওয়ার কারণে মিরসরাইয়ের প্রত্যন্ত অঞ্চলের উপর দিয়ে সকল প্রকার কানেকটিভিটি যাবে। প্রস্তাবিত বুলেট ট্রেন লেন, প্রস্তাবিত ৬ লেনের এক্সপ্রেস রোড, প্রস্তাবিত মেরিন ড্রাইভ রোড ও নগর উন্নয়ন অধিদপ্তরের মাস্টারপ্ল্যান অনুসারে ২৫০ ফুট সহ আরো ৩ টি রাস্তা উত্তর – দক্ষিণে এবং পুর্ব – পশ্চিমে মোট ৮টি ক্রস রাস্তা মিরসরাইয়ের জনবসতির বুক ছিঁড়ে নির্মাণের পরিকল্পনা হয়েছে। রাস্তার কারণে তা নতুন পকেট/বøক বøক এলাকার সৃষ্টি করবে। তাতে পাহাড়ী ঢল বর্ষা মৌসুমে ভয়ানক জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করবে। পাহাড় হতে যে স্বাভাবিক পানি সাগরে প্রবাহিত হয় তা মারাত্মক ক্ষতি সাধন করবে। পানি নিষ্কাশনের জটিল এই সমস্যা কিভাবে সমাধান হবে?

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্রমান্বয়ে আমাদের ভূগর্ভস্থ সুপেয় পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। আগামীতে অধিক জনসংখ্যার মিরসরাইতে সুপেয় পানির তীব্র সংকট দেখা দিবে নিঃসন্দেহে। অর্থনৈতিক অঞ্চলে আগত ও স্থানীয় সাধারণ মানুষের জন্য পানীয় ও চাষাবাদের পানি সরবরাহ কিভাবে নিশ্চিত করা যাবে?
পরিবেশগত নানা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে পারে মিরসরাই। প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট এসব সমস্যা মোকাবেলায় কতটুকু প্রস্তুতি আছে ?
মানুষের ও শিল্পাঞ্চলের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কোন প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন হবে?
রাস্তা ও নানা অবকাঠামো নির্মাণে অধিগ্রহণ করা হবে মানুষের জমিভিটে। নষ্ট হবে কৃষিজমি। সেক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্তদের টাকা দিলেই কি হবে শুধু? তাদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়া কিভাবে হবে?
অধিক জনসংখ্যার জন্য আবাসন, পর্যাপ্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাটবাজার ও আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে কি না?
যাবতীয় সমস্যা ও এর সমাধান দিবে কে? কোন প্রক্রিয়ায় সেটি সমাধান হবে? মিরসরাইয়ের স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে এই নিশ্চয়তা দিবে কে?

প্রাথমিক সমাধান:

নতুন রাস্তা নির্মাণের সময় ব্রিজগুলোকে (পূর্বপশ্চিমে) একই সরলরেখায় স্থাপন করতে হবে।
জলাবদ্ধতা সমস্যা সমাধানে বর্তমান খালগুলোকে প্রশস্ত করতে হবে। নতুন কমপক্ষে তিনটি কৃত্রিম সরল রৈখিক প্রশস্ত খাল খনন করতে হবে। যাতে বর্ষাকালে দ্রæত পানি সাগরে নেমে যেতে পারে।
পাহাড়ের পাদদেশে কয়েকটি পানি সংরক্ষণাগার তৈরি রাখা, সেখানে বর্ষাকালে পানি রিজার্ভ করে শুষ্ক মৌসুম-সহ সবসময় পাইপ লাইনের মাধ্যমে সকল বাসাবাড়ি-সহ প্রতিষ্ঠানে সুপেয় পানি সরবরাহ করা যায়।
অবকাঠামো নির্মাণে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের পুর্নবাসন নিশ্চিত করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুসারে যোগ্যতামাফিক ক্ষতিগ্রস্ত কৃষিজমির মালিক/কৃষক বা তার পরিবারের সদস্যদের চাকরির ব্যবস্থা করা।
সমগ্র উপজেলাকে ওয়ার্ড-ভিত্তিক ইউনিটে ভাগ করে কেন্দ্রিয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সেল তৈরি করতে হবে। যেটি বর্জ্য সংগ্রহ ও নিঃশেষ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করবে।
পরিবেশগত বিপর্যয়ের কথা মাথায় রেখে সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে দ্রুত ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
পুনরায় বনায়ন কর্মসূচী গ্রহণ করতে হবে।

সরকার মাস্টারপ্ল্যান প্রস্তুত করেছে। সবচেয়ে বড় প্রশ্নঃ এই মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়ন করবে কে? কোন প্রক্রিয়ায় এটি সম্পন্ন হবে? কারা এটি তত্ত্বাবধান করবে? আমরা মিরসরাই বাসী কাগজের পরিকল্পনাকে অবশ্যই বাস্তবে দেখতে চাই। আমরা উন্নয়ন চাই এবং এটির গর্বিত অংশীদার হতে প্রস্তুত; তবে সেটা আমাদের স্থানীয় মানুষের জীবন ও অধিকার বিপন্ন করে নয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে মিরসরাই-এর সাধারণ মানুষের এখন কি করার আছে? সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকলে কিংবা কিছু সভা-সেমিনার করলেই আমাদের পরিপূর্ণ অর্জন সম্ভব হবে? তাই, নিজেদের অধিকার সুরক্ষায় একই প্লাটফর্মে সকল দল, মত, ধর্মনির্বিশেষে সকলকে আসতে হবে। দেশের উন্নয়ন করতে গিয়ে আমরা যেন নিজভূমে পরবাসী না হয়ে যাই, আবার সরকারের কার্যক্রমও যাতে বাধাগ্রস্ত না হয়, দুদিকেই সমান খেয়াল রাখতে হবে। আমাদের তৈরি করতে হবে শিক্ষিত ও দক্ষ মানবসম্পদ। অশিক্ষিত বা স্বল্পশিক্ষিত মানুষদের কারিগরি দক্ষতা অর্জন নিশ্চিত করতে হবে।

সর্বোপরি, দরকার সচেতন বুদ্ধিভিত্তিক নাগরিক শ্রেণি। যারা কথা বলবে মিরসরাইয়ের জন্য। উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে প্রেশার ক্রিয়েটর হিসেবে কাজ করবে এই সচেতন মহল। সাধারণ, সামাজিক, স্বেচ্ছাসেবী, রাজনৈতিক, পেশাজীবী, ছাত্রসমাজ সহ সকল শ্রেণির মানুষকে এক কাতারে দাঁড়িয়ে আগামি প্রজন্মের জন্য সুন্দর ও আধুনিক নগর পল্লী ‘মিরসরাই’ গড়ে নিতে হবে। তাই এখনই উপযুক্ত সময় মিরসরাই নাগরিক অধিকার পরিষদ গঠন করার , যা দল মত ধর্ম রাজনীতির ঊর্ধে সকল সাধারণ মানুষের কন্ঠস্বর হিসেবে কাজ করবে। আমি সকল সচেতন নাগরিকের প্রতি এটির বাস্তবিক রূপ দিতে উদাত্ত আহবান জানাচ্ছি।

আরো খবর