মৃণাল চৌধুরী সৈকত, টঙ্গী: অসম্ভবকে সম্ভব করার মতো মানুষদের জন্যই পৃথিবীটা আরও সুন্দর হয়ে আছে। তাদের দেখেই বাকিরা অনুপ্রাণিত হয়ে থাকেন বেশীরভাগ সময়। এইসব মানুষের গল্প শুনলে পৃথিবীতে সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার তাগিদ আরও বেড়ে যায় সাধারণ মানুষের হৃদয়ে। বিকলাঙ্গ, পঙ্গু, অন্ধ, বধির বা পা-হাতহীন ওইসব মানুষকে সমাজে অসংখ্য অনুপ্রেরণাদাতা রয়েছেন। সাহায্য সহযোগীতা দানকারী মানুষও আছেন, আছেন অঙ্গহানী মানুষগুলোর মধ্যে কর্মক্ষমতার মাধ্যমে অন্যদের অনুপ্রেরণা জোহানদাতার অসংখ্য নজির। তাদের মধ্যে কারো না কারো সদূরপ্রসারী সাহায্যদাতার হাত ধরে এক সময় অন্যতম উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারে গাজীপুর মহানগরের টঙ্গীস্থ ৫৫ নং ওয়ার্ডের মধুমিতা এলাকার মেহের নিগার স্কুল এন্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণী পড়ুয়া দু-হাতহীন মেধাবী ছাত্রী সুমাইয়া আক্তার।
সুমাইয়া জন্মেছিলো সুস্থ-সবল দেহ নিয়ে, ছিলো পা-হাত সুন্দর অবয়ব, ছিলো সমাজে অন্যান্য শিশুদের মতোই সুস্থ সুন্দর হাসিখুশি ভাবে বেঁচে থাকার স্বপ্ন। অবুঝ মনের একটি অসাবধানতা আর পরিবার পরিজনের সামান্য ভূল আগামীর ভবিষ্যত স্বপ্নধারী শিশুটির চলমান জীবন প্রবাহে ঘটে গেছে চরম দূর্ঘটনা। ফলে শিশুটির জীবনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে সুস্থ সুন্দর জীবন চলার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বহুতল ভবনের ছাদের উপর দিয়ে যাওয়া ঝুলন্ত বিদ্যুৎ লাইন। ছাদে সহপাঠিদের নিয়ে খেলা করার সময় গত ৩ বছর পূর্বে বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে একই সঙ্গে দুটি হাত হারিয়ে মৃত্যুর পথযাত্রী হয়ে উঠে মেধাবী ছাত্রী দরিদ্র সুমাইয়া আক্তার। ফলে দরিদ্র পিতা-মাতার সংসারে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার।
মেয়েকে বাঁচাতে ফুটপাতে পিঠা বিক্রেতা দরিদ্র মাতা আর এক সময়কার ব্যবসায়ী বর্তমানে বেকার ও অসুস্থ পিতার দীর্ঘতম কষ্টকে উপেক্ষা করে সেই মেয়েটির জীবন বাঁচিয়ে তুলে পরিবারটি। তারপর থেকে সেই মেয়ে এক পা, দু-পা করে আগামীর স্বপ্ন নিয়ে-খেয়ে না খেয়ে, শিশুকালের আনন্দ উল্লাস, খেলাধুলাকে উপেক্ষা করে এগিয়ে চলছে অভাব অনটনের দূর্গম পথ পাড়ি দিয়ে। মনোযোগের সহিত চালিয়ে যাচ্ছে লেখাপড়া। পরিবারের দারিদ্রতাকে সঙ্গী করে আগামীতে নিজের অদম্য ইচ্ছেশক্তি ও মেধাকে কাজে লাগাতে সততা ও নিষ্ঠার সাথে প্রাণপণ চেষ্টায় এগিয়ে চলছে বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে দু-হাত হারানো মেধাবী স্কুল ছাত্রী সুমাইয়া আক্তার। জীবনে দু-পা আর ইচ্ছেশক্তি যার সম্বল সেই সুমাইয়া আক্তার লেখাপড়ায় যেমন মেধাবী ও মনোযোগী, ঠিক তেমনী স্কুলের প্রতিটি শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকারী শুধু দুটি পায়ের সাহায্যে। সাইন্স নিয়ে লেখা পড়া করে আগামীতে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন এবং ভবিষ্যত পরিকল্পনা নিয়ে লেখাপড়ায় এগিয়ে চলছেন দূর্বার গতিতে। শুধু মাঝ পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দারিদ্রতা।
টঙ্গীর একটি গলিপথের ফুটপাতে পিঠা বিক্রেতা সুমাইয়ার মাতা ফাতেমা বেগম জানান, ২০০৯ সালের ৩ মে পিতা কালাম গাজী এবং মাতা ফাতেমা বেগমের ঘর আলো করে জন্ম নেয় সুমাইয়া আক্তার। ৫ বছর বয়সে টঙ্গীর ৫৫ নং ওয়ার্ডের মধুমিতা এলাকার মেহের নিগার স্কুল এন্ড কলেজে নাসারীতে ভর্তি করানো হয় তাকে। স্কুলে শিশুদের সাথে হাসিখুশি পরিবেশে বেশ ভালোই কাটছিলো শিশুকাল। সুমাইয়ার পিত্রালয় পটুয়াখালীর তোসখালী গ্রামে আর মামা বাড়ি ময়মনসিংহের ত্রিশালে। দুই ভাই বোনের মধ্যে সুমাইয়া আক্তার বড়। ছোট ভাই সাইফান গাজী
একই স্কুলে নার্সারীতে পড়াশোনা করে। কর্মসূত্রে সুমাইয়ার পিতা-মাতা দীর্ঘ প্রায় ২৫ বছর যাবৎ বসবাস করেন টঙ্গীর মধুমতিা এলাকায়।
গত ৩ বছর পূর্বে মাত্র ১০ বছর বয়সে ৫ম শ্রেনীতে পড়ুয়া হাসিখুশি সুমাইয়া আক্তারের জীবনে বয়ে যায় কাল বৈশাখী ঝড়। স্থানীয় একটি বহুতল ভবনের ছাদে সহপাঠিদের সাথে খেলা করার সময় ঝুলন্ত বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে দুটি হাত ঝলসে যায়। অভাব অনটনের সংসারে মেয়েকে চিকিৎসা করাতে গিয়ে পিতা-মাতা দিশেহারা হয়ে পড়ে। দীর্ঘদিন অসুস্থ এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসার অভাবে শেষ পর্যন্ত সুমাইয়ার হাত দুটি কেটে ফেলতে হয় ডাক্তারের পরামর্শে। সেই থেকে দু-হাতহীন সুমাইয়া আক্তার প্রতিজ্ঞা করে, পা দিয়ে লেখাপড়া করে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবে। পিতা-মাতার দুঃখ গোছাবে একদিন। বর্তমানে সে ৮ম শ্রেনীরছাত্রী। মেধাবী সুমাইয়া আক্তার নার্সারী থেকে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত প্রথম স্থান অধিকারী। আগামীতে সাইন্স নিয়ে লেখাপড়া করে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন তার। কিন্তু বর্তমানে পিতার অসুস্থতায় সংসারে অভাব লেগেইে আছে। মা ফাতেমা বেগম স্থানীয় একটি গলির (রাস্তার) ফুটপাতে বসে পিঠা বিক্রি করে পিতার চিকিৎসাসহ সুমাইয়া ও তার ছোট ভাইয়ের পড়াশোনা, বাসা ভাড়া, সংসার চালানো কষ্টকর হয়ে পড়েছে। ভবিষ্যৎ শংঙ্কায় জীবন কাঁটছে মেধাবী ছাত্রী দু-হাতহীন সুমাইয়া আক্তারের। তবু থেমে নেই সুমাইয়া বা তার পরিবার।
স্থানীয় মেহের নিগার স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষক-শিক্ষিকার আংশিক সহযোগীতা এবং অনুপ্রেরণা নিয়ে এবং ভবিষ্যত স্বপ্ন বাস্তবায়নে খেয়ে না খেয়ে চালিয়ে যাচ্ছে সুমাইয়া ও তার ছোট ভাইয়ের লেখাপড়াসহ জীবন সংসার। ছাদের উপর দিয়ে টানা ঝুলন্ত বিদ্যুৎ লাইনের তারে জড়িয়ে সুন্দর ফুটফুটে ১০ বছর বয়সে সুমাইয়া আক্তারের দুটি হাত চলে গেছে, কিন্তু তাতে কি ? ইচ্ছেশক্তি আর মেধাতো হারায়নি। তাই দু-পা দিয়েই সুমাইয়া আক্তার তার লেখাপড়াসহ সব কাজ চালিয়ে যাচ্ছে অবলীলায়। বিদ্যুৎ দূর্ঘটনায় শারীরিক বিকলাঙ্গ হওয়ার পর যদিও সমাজে অবহেলা আর বঞ্চনার শিকার হতে হয়নি তাকে তথাপি দুটি হাতহীন চলমান এবং আগামী দিনের জীবনযুদ্ধে হার মানতে নারাজ সুমাইয়া আক্তার।
সুমাইয়ার পিতা কালাম গাজী জানান, অভাব অনটনে পতিত আমার ৪ সদস্যের এই দরিদ্র পরিবার। দুই হাতহীন প্রতিবন্ধী আমার মেয়ে সুমাইয়া। আমি এক হতভাগ্য পিতা, দীর্ঘদিন অসুস্থ হয়ে শয্যাগত। জায়গা-জমি, বাড়ি-ঘর অর্থ কোন কিছু নেই আমার। আমার স্ত্রী ফাতেমা পিঠা বিক্রি করে সংসারসহ ছেলে-মেয়ের লেখাপড়া চালায়। দরিদ্র পরিবারের সন্তান হওয়া সত্বেও সুমাইয়া আক্তারের স্বপ্ন লেখাপড়া করে ডাক্তার হবে। লেখাপড়া করতে অনেক টাকার প্রয়োজন, কোথায় পাবো এতো টাকা। সুমাইয়ার স্বপ্ন পূরণ করতে হলে কারো না কারো সাহায্যে প্রয়োজন, কে করবে আমাদের সাহায্য? তবুও শিশু মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে, মেয়ের স্বপ্ন পূরণের প্রত্যাশায়, আগামী দিনগুলোতে লেখাপড়া করে সুন্দর ভবিষ্যত
গড়ার লক্ষ্যে সরকারী, বে-সরকারী সাহায্য সহযোগীতা প্রয়োজন এবং প্রতিবন্ধী সুমাইয়ার ভবিষ্যৎ স্বপ্নকে বাস্তবে রুপ দিতে দেশের সূহৃদ সমাজের কেউ যদি সূদুর প্রসারী হাত বাড়িয়ে দেন কৃতজ্ঞ থাকবো চিরকাল। কেউ না কেউ সুমাইয়ার পাশে দাঁড়াবেন এই প্রত্যাশা সুমাইয়াসহ দরিদ্র পিতা-মাতার।
বিদ্যুৎ দূর্ঘটনায় শারীরিক বিকলাঙ্গ ১৩ বছর বয়সী সুমাইয়া আক্তার জানান, সমাজে দরিদ্র আর বিকলাঙ্গ-প্রতিবন্ধী, হাত-পা-হীন আমার মতো শিশু, কিশোর, কিশোরী, নারী এবং পুরুষরা কতটা অবহেলিত, আমার জীবনে এমন দূর্ঘটনা না ঘটলে জানতে পারতাম না। আমি শুধু এইটুকু বলবো, আমার মতো যেনো কারো এমন না হয়, পরম করুনাময় যেনো সবাইকে সুস্থ রাখেন। আর আমার মতো যাঁরা রয়েছেন, কেউ জন্মসূত্রে, কেউ দূর্ঘটনায় হাত বা পা-হীন বিকলাঙ্গ, তাদের বলবো, ধৈর্য্যহারা না হতে এবং নিজের জীবনের স্বপ্নগুলো বাস্তবায়নের চেষ্টা করতে। সৃষ্টিকর্তা অবশ্যই আমাদের সহায় হবেন।