ওয়াজ, ওয়ায়েজ ও ইছলাম

top Banner

নুরুল আলম তৌহিদী

ওয়াজ ইছলামী পরিভাষা। এর অর্থ আদেশ-উপদেশ। ওয়ায়েজ অর্থ উপদেশদাতা। পবিত্র কুরআনে উপদেশ বোঝাতে যে শব্দগুলো এসেছে তা হলো: তাজকিরা, যিকির, ওয়াজ। এছাড়া বয়ান বা ষ্পষ্ট ব্যাক্ষা, মাওয়িজাহ বা নির্দেশনা, কাওল বা কথামালা, তিবইয়ান বা বর্ণনা ইত্যাদি। মীলাদ, সীরাত, দরস, তাকসীর ,এ শব্দ গুলো দিয়েও ওয়াজ মাহফিলের বহুল প্রচলন রয়েছে। জুমাবারে ঈমামের আরবী ওয়াজকে খুতবা বলা হয়। যা জুমার অংশও বটে। পবিত্র কুরআনকে আল্লাহ পাক ‘মাওয়িজাতিল হাসানাহ’ বা ‘আকর্ষনীয় উৎকৃষ্ট ওয়াজ বলেছেন। আল্লাহ ও রাসূলের ওয়াজই মূল ওয়াজ। স্বয়ং আল্লাহ ওয়াজ করেছেন ত্রিশ পারা কুরআনে পাকে। অসংখ্য হাদীস রাসূলে পাকের ওয়াজ। সাহাবী, তাবেয়ী, তবে তাবেয়ী ও হক্কানী আলেমরা যুগযুগ ধরে কুরআন ও হাদীসের মাধ্যমে ওয়াজ করেছেন। যে ধারা চালু থাকবে কিয়ামত পর্যন্ত। অন্যান্য নবী রাসূলেরা ও তাদের জাতীকে ওয়াজ করেছেন। সঠিক দিশা দিয়েছেন। ওয়াজের প্রধান মাধ্যম হলো কুরআন ও হাদীস। অতঃপর ইজমা ও কিয়াস। কুরআনে আল্লাহ ওয়াজ করছেন। হাদীসে রাসূলে আমি ওয়াজ করছি এরূপ অসংখ্য শব্দ রয়েছে। আরো অসংখ্য শব্দের মাধ্যমে ওয়াজ করা হয়েছে কুরআনে ও হাদীসে।

আল কুরআনে ওয়াজ সম্পর্কে যেসব আয়াত:

বাকারা-৬৬, ২৩২, ২৭৫, ২৩১ নং। নিসা- ৩৪, ৫৮, ৬৩, ৬৬ নং, আরাফ- ১৪৫, ১৬৪ নং, হুদ-৪৬ ও ১২০ নং, সাবা- ৪৬ নং, আলে ইমরান-১৩৮ নং, মুজাদালা- ৩ নং ও নহল- ১২৫ নং আয়াত গুলোতে সরাসরি ওয়াজ প্রসঙ্গ এসেছে। পবিত্র কুরআনে সূরা ইউসুফের ১০৪ নং আয়াতে আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআনকে বিশ্বজাহানের জন্য যিকির বা ওয়াজ ও উপদেশ বলে উল্লেখ করেছেন। সুবাহানাল্লাহ।

পবিত্র কুরআনের পর ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ বক্তব্য বা ওয়াজ হলো সর্বকালের শ্রেষ্ঠ মানব ও রাসূল (স.) এর বিদায় হজ্বের ভাষণ। যা ঐতিহাসিকরাও স্বীকার করেছেন।

ওয়াজের আয়োজন:

আমাদের মনে রাখতে হবে ওয়াজ করা শোনা, আয়োজন, সহযোগিতা, সমর্থন ও অনুমোদন এসবই ইবাদত ও নেক আমল। তবে আয়োজন ছাড়াও ক্ষেত্র বিশেষ ওয়াজ করা যায়। আমাদের দেশে শীত মৌসুমে অধিক ওয়াজ মাহফিল হয়। এর মাধ্যমে মানুষ খাঁটি হয়, ঈমান পরিশুদ্ধ হয়, আল্লাহর পথে ব্যয় করতে শিখে। সুন্দর সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে এর রয়েছে সুদূর প্রসারী ভূমিকা। ওয়াজ মাহফিল আমাদের সংস্কৃতির অংশও বটে। মনে রাখতে হবে ওয়াজ মাহফিল কোন দলীয় সমাবেশ নয়। তাই ওখানে সব দলের মুসলিমরাই যান। কখনো কখনো অমুসলিমরাও মাহফিলে শরীক হন। কারণ ইসলাম সকলের কল্যাণে। ওয়াজ হলো উম্মতে মুসলিমার সুখ দুঃখ ও সমস্যার দর্পণ। গতানুগতিক মুখস্তবুলি আওড়ানোর নাম ওয়াজ নয়। মুসলিম জিবনের সকল ক্ষেত্রে স্বকীয়তা ফুটে ওঠে ওয়াজের মাধ্যমে। এক্ষেত্রে কোন মুসলিমের ওয়াজের বিরোধিতা করা বা ভ্রæ কুচকানো হারাম। হক্ব কথা বলেন এবং ঘুমন্ত মানুষকে জাগিয়ে তুলতে সক্ষম এমন সঠিক আকিদার হক্কানী আলেমদের মাহফিলে দাওয়াত দেয়া উচিত আয়োজকদের।

ওয়াজ ও ওয়ায়েজ নিয়ে সমস্যা:

রাজনৈতিক ও দলীয় বিবেচনার কারণে অনেক হক্কানী আলেম মাঠে ময়দানে ওয়াজের সুযোগ পান না বা বাধার মুখে পড়েন। কিছু আলেমদের তোষামদি মুর্খ ও চরিত্রহীনদের আঁচল তালাশের কারণেও এটি হয়। কোথাও আবার মাহফিলের অনুমতি মিলে না। বিশেষ কারণে অনেক ওয়ায়েজ আছেন- বাজে কিচ্ছা বলেন, কুরআনের ভুল ব্যাখ্যা দেন, নোংরা ভাষা ও নোংরা অঙ্গভঙ্গি করেন, আত্ম প্রচারে ব্যস্ত থাকেন, মিথ্যা হাদিস বলেন, ওয়াজের চেয়েও গান গজলের সুরে ব্যস্ত থাকেন, শিশু হুজুর, অন্ধ হুজুর, নারী হতে পুরুষ হওয়া আম্মা হুজুরদের উৎপাত ও ধান্ধা, সারারাত ওয়াজ করে ফজর পড়ার সুযোগ না রেখে মাহফিল শেষ করেন, তথ্যহীন ওয়াজ করেন, কুরআন হাদীস মোটেই বলেন না, ফেরকা বা দলাদলি, কাদা ছোড়াছোড়ি করেন, উগ্রতা প্রদর্শন করেন, এলম অর্জনের চেয়েও ওয়াজ বেশি করেন, সমাধানকৃত বিষয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করেন, মাজহাবের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেন, মিথ্যা কেরামত বয়ান করেন, শেখানো কথাগুলো ওয়াজে বলেন, ওয়াজের স্টেজে জিকিরের নামে গান গেয়ে নাচতে নাচতে উন্মাদনা সৃষ্টি করেন, বাহারী পোষাক পাগড়ি ও উদ্ভট দৃশ্যে নিজকে স্টেজে উপস্থাপন করেন ও অযৌক্তিক আর্থিক কন্টাক্ট করতে যেয়ে আয়োজক ও মুসলিম শ্রোতাদের বিব্রত করেন। এখানে আমি কমই বলেছি। ভন্ড ওয়ায়েজ যারা তাদের আরো ত্রæটি রয়েছে। ভদ্রতার খাতিরে বললাম না।

আল্লাহ যেভাবে ওয়াজ করতে শিখিয়েছেন:

আগেই বলা হয়েছে, পবিত্র কুরআনই আল্লাহর ওয়াজ। সুতরাং কুরআনের কোন বক্তব্য গোপন করা হারাম। আল্লাহ কুরআনের বক্তব্য গোপনকারীকে বড় জালেম বলেছেন। সূরা আলে ইমরানের ৫৮ নং আয়াতে কুরআনকে বিজ্ঞানময় উপদেশ বলেছেন। আল্লাহ ইসলামকে পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা বানিয়েছেন। তাই সে আলোকেই ওয়াজ করতে হবে। কুরআন প্রয়োজনমত ২৩ বছরে অবতীর্ণ হয়। একজন বক্তাকেও প্রয়োজনমত প্রেক্ষাপট অনুযায়ী সমকালীন প্রসঙ্গে ওয়াজ করতে হবে কুরআনের আলোকে। আল্লাহ বলেন, ‘হে রাসুল, আপনি আপনার প্রভূর পথে প্রজ্ঞা ও উৎকৃষ্ট ওয়াজ দ্বারা আহবান করুন। এমন পদ্ধতিতে বিতর্ক করুন যা উৎকৃষ্ট পন্থা’- সূরা নহল (১২৫)। এছাড়া সুরা লোকমানের ১৩ হতে ১৯ নং আয়াত পর্যন্ত লুকমান (আ.) যে বিষয়ে সন্তানকে ওয়াজ করেছেন সে বিষয় ও নিয়ম হলো আল্লাহর ওয়াজের শিক্ষা। মূসা আ. ও হারুন আ. কে আল্লাহ ফেরাউনের কাছে গিয়ে তাগুতকে রুখতে তার সাথে ন¤্র ভাবে কথা বলতে নির্দেশনা দিলেন- সুতরাং উগ্রতার ওয়াজ ঠিক নয়। সুরা আসরে আল্লাহ মুক্তির চারটি রূপরেখা বলেছেন- ১. ঈমান ২. নেক আমল ৩. হকের উপদেশ ৪. ধৈর্য্যরে উপদেশ। নিকৃষ্ট আওয়াজে ওয়াজ করা বা কথা বলা বেয়াদবি। আল্লাহ বলেছেন- নিশ্চয়ই সবচেয়ে নিকৃষ্ট আওয়াজ হচ্ছে গাধার আওয়াজ (সূরা লোকমান-১৯)। বোঝা গেলো মিষ্টি আওয়াজে ওয়াজ করা আল্লাহর শিক্ষা।

নবী (স.) যেভাবে কথা বলতেন বা ওয়াজ করতেন: ‘রাসূল (স.) এমনভাবে কথা বলতেন তা গুনে নেয়া যেতো’- বুখারী ১৫১১। ‘রাসূল (স.) অশ্লীল কথা বলতেন না। অভিশাপ দিতেন না, গালিও দিতেন না’- বুখারী ১৫১২। ‘রাসূল (স.) বলেন, কোন বিষয় প্রকাশ ও প্রচার গোপনকারী মিথ্যুক। কারণ আল্লাহ বলেন, হে রাসুল আপনার উপর যা নাজিল হয়েছে আপনার রব হতে তার সবই পৌছে দিন’-বুখারী ১৫৪৪। ‘রাসুল (স.) যখন কোন কথা বলতেন তখন তা তিনবার পুনরাবৃত্তি করতেন। যাতে শ্রোতা বুঝতে পারে’- বুখারী। ‘রাসুল স. এর কথা ছিলো খুবই ষ্পষ্ট ও পরিষ্কার। শ্রোতারা তার বক্তব্য ষ্পষ্ট বুঝে নিতো’- আবু দাউদ। ‘ রাসুল স. বক্তব্যের পূর্বে সবাইকে চুপ করিয়ে দিতেন, যা বিদায় হজ্বের ভাষণেও করেছেন’-বুখারী। ‘বিরক্ত না হয় এমন ওয়াজ করা উচিত, রাসুল এমনই করতেন। প্রতিদিনই রাসূল ওয়াজ করতেন না’-বুখারী। ‘রাসুল স. বলতেন দীর্ঘ সালাত সংক্ষিপ্ত বক্তব্য ব্যক্তির বুদ্ধিমত্তার পরিচয় বহন করে’- মুসলিম। ‘প্রিয় রাসুল স. যখন ওয়াজ করতেন, সাহাবীদের চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে যেতো’-ইবনে মাজহা। অন্য হাদীসে আছে রাসুলের ওয়াজ শোনাকালে সাহাবীরা এতই মনোযোগী থাকতেন যে তাদের মাথায় পাখি বসে যেতো। সুবহানাল্লাহ।

আদর্শ ওয়ায়েজের বৈশিষ্ট:

আমরা বৈশিষ্টগুলো পূর্বের লেখা হতেও খুজে নিতে পারি। পবিত্র কুরআনে ৬৬৬৬টি আয়াত। এর মধ্যে আদেশ ১ হাজার, নিষেধ ১ হাজার, জান্নাতের সুখবর ১ হাজার, দোজখের ভয় ১ হাজার, উপমা ১ হাজার, কাহিনী ১ হাজার, হালাল ২৫০ হারাম ২৫০ ও বিবিধ ৬৬ টি আয়াত। এ বিষয়গুলো একজন ওয়ায়েজকে গভীর অধ্যয়নের মাধ্যমে আয়ত্ব করার চেষ্টা করতে হবে। মনে রাখতে হবে বক্তা শুধুই আখিরাতের ওয়াজ করবেন না তাকে দুনিয়া সম্পর্কেও জানতে হবে ও বলতে হবে। কারণ কুরআনে দুনিয়া শব্দটি ১১৫ স্থানে, আখিরাত শব্দটিও ১১৫ স্থানে রয়েছে। তাই আখিরাতমুখি করে দুনিয়া সাজাবার ওয়াজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ওয়ায়েজ প্রতিদান কামনা করবেন না। অর্থের পিছু দৌড়াবেন না। তবে ওয়াজের পরে হাদিয়া স্বরূপ দিলে তা নেয়া যাবে। বরং হাদিয়া একটি বড় সুন্নত। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা অনুসরণ করো তার, যে তোমাদের কাছে কোন প্রকার প্রতিদান চায়না’- ইয়ছিন ১১। এখানে রাসুলের কথা বলা হলেও ওয়ায়েজদেরও একই বৈশিষ্ঠ প্রয়োজন।বিষয় ভিত্তিক ওয়াজ করা উচিত। কারণ স্বয়ং আল্লাহ, তার রাসুল, সাহাবী, পূর্ব যুগের হক্কানী আলেমগণ বিষয়ভিত্তিক ওয়াজ করেছেন। কুরআন হলো আমানত, কুরআনের কথা না বললে আমানতেরই খেয়াণত হয়ে যায়। তাই শুদ্ধভাবে তেলাওয়াত ও এর অর্থের তাফসিরে পান্ডিত্য অর্জনের চেষ্টা করতে হবে। ভাসাভাসা জ্ঞানে ওয়াজ হয়না। সেটি খেয়াল রাখতে হবে। প্রচুর পড়ালেখা করে ওয়াজের স্টেজে বসতে হবে। তায়াউজ, তাসমিয়া, সালাম, হামদ দরুদ থাকবে ওয়াজে। ওজু করে খালেস নিয়তে নিরহংকার মনে ওয়াজ করা কর্তব্য। কুরআন হাদীসের ওয়াজে যোগবিয়োগ করা হারাম। অপ্রয়োজনীয় কথা ওয়াজে বর্জনীয়। আল্লাহ বলেন, যারা অর্থহীন বিষয় হতে বিমুখ থাকে, (সূরা মুমিনুল ৪) জালেম শাসকের সামনে হক কথা বলবে- রাসূল বলেন, উত্তম জিহাদ হলো জলেম শাসকদের সামনে হক কথা বলা (হাদীস) আল্লাহর পথে আহবানকারী হবেন ওয়ায়েজ। রাসুলরাও তাই ছিলেন। সব নবীরা ৪ টি কাজ করেছেন। ওয়ায়েজদেরও তাই করতে হবে। ওয়ায়েজ নিজেকে আমলে লাগাতে হবে। তাচেৎ অন্যকে ওয়াজ করবে না। আল্লাহ বলেন, ‘তা কেন বলো তোমরা যা নিজে করো না?’-সুরা সফ ২। আল্লাহ আরো বলেন, ‘তোমরা মানুষকে আদেশ করো নেক কাজের, অথচ নিজেদের ভুলে থাকো?-বাকারা ৪৪। ওয়াজ করতে হবে এভাবে, তোমরা এক আল্লাহর এবাদত করো, আর তাগুতকে অস্বীকার করো। বলো যা সব নবীরাই করেছেন। ওয়ায়েজরা দায়ি ইলাল্লাহর দল। আল্লাহ বলেন,‘তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল থাকা উচিত যারা কল্যাণের দিকে ডাকবে, ন্যায়ের আদেশ দিবে, অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখবে। এরাই হচ্ছে সফল’- আল ইমরান ১০৪। ওয়ায়েজকে লক্ষ্য রাখতে হবে আল্লাহই হেদায়াতের মালিক। ওয়ায়েজকে কিতাব তথা দ্বীনের প্রাজ্ঞ ব্যক্তি হওয়া চাই। অন্যথায় আল্লাহ বলেন,‘ তোমরা যদি না জানো তাহলে আহলে যিকির বা কিতাব ওয়ালা হতে জেনে নাও’। এ আয়াতের আলোকে কজন ওয়ায়েজ বা আলেম আছেন তা চিন্তা করে দেখুন। ভাইরাল বক্তা ও যোগ্য আলেম হওয়া অনেক তফাৎ। আলেম ছেড়ে ভাইরাল বক্তা নিয়ে ব্যস্ত লোকের অভাব নেই এখন। বিশুদ্ধ উচ্চারণ, প্রাঞ্জল হৃদগ্রাহী মধুর ভাষায় ওয়াজ করতেন বিশ্বনবী। যেজন্য দূর দূরান্ত থেকে দলে দলে লোকজন আসতো তার কথা শুনতে। তার বক্তব্য যেন মুক্তার মালা। একজন ওয়ায়েজ দায়ি ইলাল্লাহ তাই ওয়াজকে সে পেট চালাবার মাধ্যম বানাতে পারে না। ওয়াজে সুসংবাদ ও সতর্কতা থাকতে হবে। শ্রোতাদের হতাশ করা চলবেনা। পরিচ্ছন্ন কৌতুক, সত্যগল্প, শিক্ষনীয় কাব্য ও উপমার ব্যবহার রাসুলের সুন্নত। প্রয়োজনে ওয়াজ দীর্ঘ করা যায়। ওয়াজ বোঝানের জন্য শ্রোতার যোগ্যতা মতো তাদের স্থানীয় ভাষার ব্যবহার করা উত্তম। ভাষার জড়তা দূর করতে ও যোগ্যতা বাড়াতে ওয়াজকে বোধগম্য করতে মূসা আ. যে দুআ’টি করেছেন তা পড়া উচিত। অর্থ বুঝে পড়াই গুরুত্বপূর্ণ। ওয়ায়েজকে হতে হবে কথায়, কাজে, আচরণে, লেনদেনে, ইমানে, আমলে, যোগ্যতায়, সততায়, চরিত্রে, রুচিতে সুন্দর ও অতুলনীয়। পবিত্র কুরআনের সুরা মুদ্দাস্সির ও মুজাম্মিলে ওয়ায়েজের বৈশিষ্ঠ বিবৃত হয়েছে যা রাসূল স. কে আল্লাহ দান করেছেন। ইমান, শিরক, কুফর, বিদাত সহ একান্ত বিষয়গুলো বেশি আলোচনা করবেন ওয়ায়েজ। শ্রোতার রোগ ও ঔষধ বুঝতে হবে ওয়ায়েজেকে। তাওহিদ রেসালাত আখিরাত হবে ওয়ায়েজের বক্তব্যের সেতু। ক্ষোভ প্রকাশ, ঘৃণা প্রকাশ, নিন্দাবাদ, আক্রমন, কাউকে ঘায়েল করা, ঝগড়া বাধিয়ে দেয়া আদর্শ বক্তার বৈশিষ্ঠ নয়। কারণ রাসুল স. বলেন, ‘ দ্বীন হচ্ছে কল্যাণকামনা একে অপরের জন্য’। অন্ধকার পথগুলো হতে আলোর একমাত্র পথ দেখাবেন ওয়ায়েজ। কারণ রাসুল তাই করেছিলেন। সকল মিথ্যা জীবন ব্যবস্থার অসারতা, প্রমাণ করবেন ওয়ায়েজ। বিজ্ঞান, তথ্য, যুক্তি দিয়ে শ্রোতাকে সঠিক বার্তা দিতে হবে ওয়ায়েজকে। প্রয়োজনীয় ছোট বড় কোন কথা বলতে ওয়ায়েজ লজ্জাবোধ করবেন না। ওয়াজে সুন্দর সুরেরও সুফল আছে। তাই সম্ভব হলে সুরকেও কাজে লাগাবেন। হক্কানী ও ভালো মানের ওয়ায়েজদের ওয়াজ শুনা উচিত ওয়ায়েজদের। ওয়াজের জন্য পয়েন্ট ও নোট তৈরী করা যেতে পারে। মনে রাখতে হবে, ইলম মোমিনের হারানো সম্পদ। যেখানে পাবে কুড়িয়ে নেবে।’ তাই নিজেও ওয়াজ মাহফিলের শ্রোতা হতে হবে। মনে থাকে মতো দরকারী বিষয়ে ওয়াজ করা সুন্নত। ওয়ায়েজকে মনে রাখতে হবে শ্রোতারা আমার ছাত্র। তবে সেখানে ওস্তাদতুল্য কেউ থাকতে পারেন। প্রয়োজনের চেয়ে উচ্চ আওয়াজে ওয়াজ করা ঠিক নয়। অহেতুক নিজেকে জাহির করার জন্য চিৎকার দেবেন না যেন। ওয়াজের বিষয়ের ধরণ অনুযায়ী সুখ, দুঃখ, বেদনা, হাসি, কান্না প্রকাশ পায় যেন। কেয়ামতে ওয়ায়েজ যারা নিজেই আমল করেন না তাদের নাড়ি ভুড়ি বের হয়ে থাকবে। লোকেরা তামাশা দেখবে। ওয়ায়েজরা ঘুরবে। এরচেয়ে দুঃখ কি হতে পারে?

ওয়ায়েজদের বিলাসিতা:

কিছু ওয়ায়েজ দেখা যায় এরা যেন যাত্রা গানের রাজা। এদের পোষাকই তাই বলে। এরা খাদ্য তালিকা দেয় কি খাবেন? জানিয়ে দেন কত টাকা দিতে হবে? পিএস ছাড়া কথা বলবেন না। ওয়াজের পূর্বে নতুন দুলার মতো সাজতে থাকেন। কেউ কেউ বলেন সিডিউল খালি নেই ইত্যাদি। এসব কি হক আলেমের রুচি হতে পারে? মোটেই না।

ওয়াজ শোনা:

স্বয়ং রাসুল স. দ্বীনি মাহফিলে বসেছেন। ওয়াজে রওয়ানা হলেও কদমে কদমে নেকি হয়। অন্যকে ওয়াজ শুনতে জায়গা করে দিলে আল্লাহ জান্নাতে স্থান দেন। ওয়াজের স্থানটুকুন জান্নাতের বাগান হয়ে যায়। অবশ্য, অযোগ্য আলেমের ওয়াজ শুনলে ঈমানের ক্ষতি হয়। যেমন, অযোগ্য ডাক্তার রোগী মেরে ফেলে। ওয়াজ শুনার আদব ৩ টি। যা সূরা আরাফের ২০৪ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘যখন (তোমার সামনে) কোরআন তেলাওয়াত করা হয় মন দাও, তা শোন এবং নিশ্চুপ থাকো। আশা করা যায় তোমাদের উপর দয়া করা হবে।’ প্রিয় পাঠক ওয়াজের মাহফিলকে ফেরেশতারা ঢেকে রাখে, প্রশান্তি নাজিল হয়, আল্লাহ ওয়াজে থাকা শ্রোতাদের ক্ষমা করে দেন ফেরেশতাদের স্বাক্ষী করে। সুবহানাল্লাহ। সাহাবায়ে কেরাম রাসুল স. কে ওয়াজ করতে অনুরোধ করতেন। রাসুল স. ওয়াজ শোনাতেন।

শেষ কথা:

প্রিয় পাঠক, ওয়াজ আমাদের মুসলমানের ঐতিহ্য। জ্ঞানপাপীরা ওয়াজ নিয়ে ঠাট্টা করে। সবগুলো ইসলামী রীতিনীতি এখানে আলোচনা হয়। যিনি যতটুকু জানেন, দ্বীনি ওয়াজ যার যার নিজস্ব পরিসরে করে যেতে হবে। রাসুল স. বলেছেন ‘বয়ানে জাদুর মতো প্রভাব রয়েছে।’-মেশকাত। ওয়াজ কোনো অযৌক্তিক, অবৈজ্ঞানিক বিষয় নয়। কারণ কুরআনের ৮৯ % বিজ্ঞান। সুবহানাল্লাহ। প্রাচীন ও আধুনিক ওয়াজের ধারা ও পদ্ধতিগত কিছু পার্থক্য দৃশ্যমান। এতে কোন সমস্যা নেই। কারণ ইসলাম যুগে যুগে আধুনিক ও সময়োপযোগী ওয়াজে তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার অবৈধ নয়। কারণ আল্লাহ হিকমতের মাধ্যমে ওয়াজ করতে বলেছেন। ওয়ায়েজদের বলব আধুনিক কৌশলে সুন্নাতের অনুসরণে ওয়াজ করুন। রুগী নিরামিশ খেতে চায়না। তবু দিতে হয় ডাক্তারকে। তেমনি ওয়াজও করতে হবে। কারণ আমাদের কাজ হক কথা পৌছে দেয়া। ওয়াজ হলো সত্য ও সুন্দরের ধ্বনি, ঈমান ও আমলের সুমধুর মোহন বাঁশি। মোহাম্মদ স. ঈমানের সুর বাজিয়েছিলেন। সিরাজুম মুনিরার উত্তরসূরী হিসেবে আমরাও সে নুরানী সূরের মূর্ছনায় গোটা পৃথিবীকে বিমোহিতো করবো ইনশাআল্লাহ। কোরআনের এই সুর কেউ ভঙ্গ করতে পারবে না। বাংলাদেশের ৯০ ভাগ মুসলিম। তাই সবকিছুর উর্ধ্বে উঠে আসুন ওয়াজ ও ওয়ায়েজদের সহযোগীতা করি। দ্বীনের স্বার্থে, সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থে আমরা ওয়ায়েজদের বিপরীতে যেন না দাঁড়াই। ঘুমন্ত মজলুম মুসলিম উম্মাহকে জাগিয়ে তুলি ওয়াজের মাধ্যমে। যে ওয়াজ ঘুমন্ত শ্রোতাকে জাগাতে অক্ষম তা ওয়াজ নয়, আওয়াজ মাত্র। আর হ্যাঁ রাসুল স. বলেছেন, ‘মৃত্যু হলো ওয়াজ ব ওয়ায়েজ হিসেবে যথেষ্ট।’

নুরুল আলম তৌহিদী
খতিব
ঐতিহাসিক ছুটি খা মসজিদ

আরো খবর